জেনে নিন রোজার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা

স্বাস্থ্য ডেস্ক: রোজা রাখা মানেই হচ্ছে সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে মাগরিবের ওয়াক্ত পর্যন্ত সব ধরণের খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকা। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একমাস সিয়াম সাধনার পরকালীন এবং রূহানী উপকারিতা হয়তো অনেকেই জানেন। কিন্তু সারাদিন না খেয়ে থাকার মধ্যে যে অসাধারণ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতাও রয়েছে তা হয়তো অনেকেরই অজানা।

অনেকে মনে করে থাকে এবং প্রচারও করে থাকে যে, এই লম্বা সময়ে একেবারেই না খেয়ে থাকা শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ক্ষতিকর। বিশেষ করে এই গরমের দিনের প্রায় ১৫ ঘণ্টার মতো পানিয় পান করে না থাকার ক্ষতিকর দিক নিয়ে অনেকেই চিন্তিত থাকেন। কিন্তু মেডিক্যাল সাইন্স ও স্বাস্থ্য বিষেশজ্ঞদের মতে এমন ধারণা সম্পূর্ণরূপে কল্পনাপ্রসূত এবং অবান্তর। তাহলে আজ জেনে নিন রোজা রাখার দারুণ সব স্বাস্থ্য উপকারিতা।

স্বাস্থ্যবিজ্ঞান মতে আমাদের অজান্তেই রোজা রাখার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন ধরনের উন্নতি হয়ে থাকে। এমনকি অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্যও রোজা রাখা উপাকারী। তো আসুন জেনে নেওয়া যাক রোজা রাখলে আপনি কি কি উপকারীটা পেতে পারেন।

অ্যালার্জি, সর্দি-কাশির রোগীদের জন্যঃ

অ্যালার্জি, সর্দি-কাশির রোগীদের রোগের উসিলা দিয়ে অযথা নিজ সিদ্ধান্তে রোজা না রাখার কোনো ভিত্তি নেই। এসব রোগে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক, এন্টিহিস্টোমিন কিংবা স্টেরয়েড স্প্রে দিনে দু’বার বা একবার খেলে বা ব্যবহার করলেই চলে। তবে খানাখাদ্যের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

স্থূলকায় রোগীদের জন্যঃ

অতিরিক্ত আহার বর্তমানে অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা। তাই ইসলামে হালকা ভোজনই কাম্য। বেশি বেশি খাদ্য গ্রহণের ফলে দেহে চর্বি জমে অনেকে বেশ স্থূল বা অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যায়। যা স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, বিব্রতকর ও কষ্টকর। এ চর্বি শরীরের চামড়ার নিচে কলেস্টেরল আকারে শিরা-উপশিরা-ধমনীতে এমনকি হৃৎপিণ্ডেও জমা হয়।

যার ফলে শরীরে স্বাভাবিক রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। কিন্তু রোজা রাখার কারণে স্থূলকায় রোগীর শরীরে জমে থাকা এসব কোলেস্টেরল শরীরের কাজে ব্যয়িত হয়ে যায় এবং স্বাভাবিক হয় রক্তের সার্কুলেশন। তবে এ জাতীয় রোগীরা ইফতার ও সেহরিতে ভূরিভোজন না করে অবশ্যই হালকা খাবার খেতে হবে।

হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানি রোগীদের জন্যঃ

হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানি রোগীদের জন্য রোজা উপকারী। রোজার ফলে রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে। তা ছাড়া রোজা রাখার কারণে স্ট্রেস হরমোন করটিসেলের নিঃসরণ কমে। এতে বিপাকক্রিয়া ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। রোজার ফলে মস্তিষ্কের সেরিবেলাম ও লিমরিক সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে বিধায় মনের অশান্তি ও দুশ্চিন্তা দূর হয়, কর্মোদ্দীপনাও বাড়ে, যা উচ্চ রক্তচাপের জন্য মঙ্গলজনক। অধিকাংশ হাঁপানি রোগীর ক্ষেত্রেই রোজা উপকারী।

ডায়াবেটিক রোগীদের জন্যঃ

যেসব মানুষ ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য মুখে ওষুধ গ্রহণ করছেন, খাদ্য তালিকা মেনে চলছেন এবং ওজন কমাতে চাচ্ছেন­ তাদের জন্য রোজা খুবই উপকারী। বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে হাইপো গ্লাইসেমিয়া হয়ে না যায়। যারা দু’বেলা ইনসুলিন নিচ্ছেন তাদের জন্য তো কথাই নেই বরং যারা দু’বেলার অধিক ইনসুলিন নেয়, তাদেরও চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ডোজ অ্যাডজাস্ট করে রোজা রাখতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

আলসার বা পেটের পীড়ার রোগীদের জন্যঃ

দেখা যায়, পেপটিক আলসারের রোগীরা রোজা রাখলেই ভালো বোধ করেন। কারো কারো ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। তবে তাদের জন্য রোজার বিষয়টি অনুশীলনের ওপর নির্ভর করে। আলসার বা এ জাতীয় সমস্যায় সাধারণত দৈনিক দু’বারের বেশি ওষুধ সেবন করতে হয় না। যার জন্য রোজা রাখতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।

ধূমপানকারীদের জন্যঃ

ধূমপান করা মানেই বিষপান করা। এ কথা আধুনিক যুগে কে না জানে। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের এ আবিষ্কারের বহু আগেই ইসলাম ধূমপান নিষিদ্ধ করেছিল। ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ওপর নিকোটিনের দাগ পড়তে পড়তে এক সময় ধূমপায়ী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। রমজানের রোজার ফলে ধূমপান থেকে বিরত তাকার কারণে ফুসফুস দীর্ঘসময় পর্যন্ত নিকোটিনের বিষক্রিয়া মুক্ত থাকে। ফলে ফুসফুস রোগমুক্ত থাকে এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসে। যারা ধূমপান করেন রমজানের রোজা তাদের জন্য অবশ্যই উপকারী। ধূমপান বর্জনেরও এটা উত্তম সময়।

দেহ থেকে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করেঃ
রোজা রাখার ফলে দেহের ফ্যাট ক্ষয় হয়। এবং এই ফ্যাটের সাথে থাকা ক্ষতিকর টক্সিনও ফ্যাটের পাশাপাশি দূর হয়ে যায় দেহ থেকে।

পরিপাকতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিঃ
রোজা রাখা সময়টাতে সর্বক্ষণ চলতে থাকা পরিপাকতন্ত্রটি একটু হলেও বিশ্রাম পায়। ফলে পরিপাকতন্ত্র তার পূর্ণউদ্যমে কাজের সুযোগ পায়। তাই কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। তবে অবশ্যই লক্ষ্য রাখবেন পুরো দিন রোজা রেখে একসাথে অনেক খাবার খেয়ে ফেলবেন না।

কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীদের জন্যঃ

রোজার সময় যেহেতু দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকতে হয়, তাই কারো কারো পানি স্বল্পতা হতে পারে। যা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীদের জন্য সমস্যার ব্যাপার। তারা ইফতার ও সেহরিতে প্রচুর পরিমাণ পানি, ডাবের পানি, ফলের রস, সরবত, শাকসবজি, সালাদ, ইসবগুলের ভুসি খেলে আরাম করে রোজা রাখতে সমস্যা হবে না। গরু বা খাসির গোশত, ইলিশ ও চিংড়ি মাছ এবং যেসব খাবার খেলে মল শক্ত হয়ে যায় তা না খাওয়াই ভালো।

রোজার বিষয়ে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডা. শেলটন বলেছে, উপবাসকালে শরীরের মধ্যকার প্রোটিন, ফ্যাট, শর্করা জাতীয় পদার্থগুলো স্বয়ং পাচিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোর পুষ্টি বিধান হয়। এই পদ্ধতিকে ‘অ্যাস্টোলিসিস’ বলা হয়। (সুপিরিয়র নিউট্রিশন গ্রন্থ)।

স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডা. আব্রাহাম জে হেনরি রোজা সম্পর্কে বলেছে, রোজা হলো পরমহিতৈষী ওষুধ বিশেষ। কারণ রোজা পালনের ফলে বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে মানুষ কম আক্রান্ত হয়।’

স্বাস্থ্য গবেষকদের মতে, সারা বছর অতিভোজ, অখাদ্য কুখাদ্য, ভেজাল খাদ্য খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরে যে জৈব বিষ জমা হয় তা দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এক মাস রোজা পালনের ফলে তা সহজেই দূরীভূত হয়ে যায়।

উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখেঃ
রোজা রাখার সময় আপনাআপনিই দেহের রক্তচাপ কমে আসে। এতে করে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা অনেকটাই ভালো থাকেন রোজার সময়ে। তবে রক্তচাপ কম বলে অতিরিক্ত কোলেস্টোরলযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত নয়। এই ব্যাপারে নজর দিন।

ধূমপান ও মদ্যপানের খারাপ অভ্যাস দূর করতে সহায়তা করে-
পুরো একটি মাস যদি রোজা রাখতে পারেন তাহলে আপনার প্রতিদিনের ধূমপান বা মদ্যপানের রুটিনে একটু হলেও ভাটা পড়ে আসবে। এতে করে চাইলে আপনি রোজার মধ্যেই এই বাজে অভ্যাসটা দূর করে নিতে পারবেন।

স্বাস্থ্য ঠিক রাখে-
অনেকেই রোজার সময়েই বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে যান, সারাদিন রোজা থাকতে হবে বলেই সেহরিতে স্বাস্থ্যকর খাবার এবং পানি পান করে নেন। আবার রোজা রাখা হয় বলে বাইরের ফাস্টফুডও বেশ কম খাওয়া হয়, এতে করে দেহ অনেকটাই সুস্থ থাকে।

একনজরে স্বাস্থ্য উপকারিতা:
 ১. ওজন কমায়

২. ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বাড়ায়

৩. অধিক বছর বাঁচার সক্ষমতা বাড়ায়

৪. হরমোনের সঠিক কার্যক্ষমতা বাড়ায়

৫. হজম শক্তি বাড়ায়

৬. সঠিক খাদ্যাভাস গড়ে তোলে।

৭. মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়

৮. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

৯. শরীর ও মন প্রফুল্ল রাখে

১০. দৈহিক সোন্দর্য বাড়ায়