ইসরাইলে হামলা চালালেও আমি বলতাম আইএস ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি – সাহাদত হোসেন খান

ডেস্কঃ দেশবরেন্য লেখক ও কলামিস্ট সাহাদত হোসেন খান সম্প্রতি সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন ‘ইসরাইলে হামলা চালালেও আমি বলতাম আইএস ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি’। ইসলামের নামধারী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইএসএস এর উৎপত্তি প্রসঙ্গে নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বিশ্লেষন করেন সাহিত্যক সাহদত হোসেন খান। নিউজ নাইন২৪ডটকমের পাঠকদের জন্য তাঁর পুরো লেখাটি এখানে হুবহু পরিবেশন করা হলো-

ইসলামিক স্টেট বা আইএসকে নিয়ে কম-বেশি সবাই কথা বলেন। তাদের উৎপত্তি ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ ধরনের প্রশ্ন তোলা খুবই স্বাভাবিক। এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বহু দেশে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। অতি সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশি দেশ শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে। এসব সন্ত্রাসী হামলার চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও মোটিভ বিশ্লেষণ করে সবাই একমত যে, আইএস ইসরাইলের সৃষ্টি এবং আইএসের শীর্ষ নেতা আবু বকর আল-বাগদাদী ইহুদি। এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সব দেশে বর্বর হামলা চালালেও এ পর্যন্ত ইসরাইলে কখনো সন্ত্রাসী হামলা না চালানোর জন্য এ সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের সঙ্গে ইসরাইলের নৃশংস আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে সবাই এ ধরনের সন্দেহ পোষণ করেন। সম্প্রতি অভিনেতা ও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আসাদুজ্জামান নূর এক আলোচনাসভায় অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে উল্লেখ করেন যে, ইসরাইল অতি কাছে হলেও আইএস সে দেশে হামলা চালায়নি। আমি এ যুক্তির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তবে একই সঙ্গে কেন জানি আমার মনে এ প্রশ্নও উঁকি দেয় যে, ইসরাইলে হামলা চালালেও আইএসকে ইসরাইল বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো যুক্তি নেই। ইসরাইলে হামলা চালালেও আমি বলতাম আইএস ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি। এমন উদাহরণ তো আমাদের সামনে অনেক আছে।
১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট বাহওয়ালপুরে এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক নিহত হন। জেনারেল জিয়াউল হকের সঙ্গে আরো নিহত হয়েছিলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড রাফেল ও মার্কিন দূতাবাসের সামরিক এটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হার্বার্ট ওয়াসম। অনেক পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা করে জিয়াউল হকের বিমান উড়িয়ে দেয়া হয়। মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাফেল ও মার্কিন সামরিক এটাশে ব্রিগেডিয়ার ওয়াসম নিহত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে সন্দেহ করা কঠিন হয়ে ওঠে। হাইপ্রোফাইল হামলাগুলো বরাবর রহস্যের আবরণে ঢাকা থাকে। রহস্য উন্মোচন দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তবে মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। দুনিয়ার কোনো রহস্য চিরদিন ঢাকা থাকে না। কোনো না কোনোদিন প্রকাশ পায়। ঘটনার গভীরে তাকালে দেখা যায় যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক পরিকল্পিত হত্যাকা-ের শিকার। এ হত্যাকা- সংঘটিত হয় পাকিস্তানের কথিত মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের ছক অনুযায়ী। বাহওয়ালপুরে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পাকিস্তানের সদ্য আমদানিকৃত এবারমস ট্যাংকের মহড়া ছিল ওছিলা মাত্র। জিয়াউল হক যেতে চাননি। তাকে কাকুতি মিনতি করে নিয়ে যাওয়া হয়।
জিয়াউল হকের বিমান উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে যাদের সন্দেহ করা হয় তাদের মধ্যে ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, আফগান গোয়েন্দা সংস্থা ওয়াদ ও আল-জুলফিকার। উল্লেখিত শক্তিগুলোকে বাদ দিলে তালিকায় থাকে একমাত্র সিআইএ। এখানে এসে সবার চোখ স্থির হয়। এখন প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে যুক্তরাষ্ট্র কেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে হত্যা করতে যাবে। এ প্রশ্নেব যথাযথ জবাব আছে। পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র একযোগে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধী প্রতিরোধ লড়াইয়ে সহায়তা দিয়েছে। আর এ ইস্যুতেই উভয়ের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল তারা যেভাবে চাইবে সেভাবে আফগানিস্তানে প্রতিরোধ লড়াই চলবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াইউল হক নিজস্ব বিচার বুদ্ধিতে চলতে গিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্র আফগান মুজাহিদদের দেদার সহায়তা দিতো। কিন্তু দেশটি সতর্ক ছিল যাতে এ সহায়তা হেযব-ই-ইসলামি নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হাতে না পড়ে। হেকতিয়ার ছিলেন চরম মার্কিন বিরোধী। এ সত্য জানা থাকা সত্ত্বেও জিয়াউল হক গোপনে মার্কিন সামরিক সহায়তার একটি বিরাট অংশ তার কাছে পাচার করেছিলেন। মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ জানতে পারে যে, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার জিয়াউল হকের সমর্থন নিয়ে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। এ খবর পেয়ে সিআইয়ের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে হেকমতিয়ারের কাছে মার্কিন সামরিক সহায়তা পাচার করাই জিয়াউল হকের একমাত্র দোষ ছিল না। পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গোপনে পরমাণু বোমা তৈরির উপাদান ক্রাইটন আমদানি এবং একটি ইসলামি জোট গঠনের উদ্যোগ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জিয়াউল হকের মূল অপরাধ।
জিয়াউল হকের হত্যাকা-ে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত কিনা এ ব্যাপারে অন্য কারো সন্দেহ থাকলেও তার আত্মজা রুবিনা হকের কোনো সন্দেহ নেই। মিসেস রুবিনা হক সালিম আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। তিনি বহুবার বাহওয়ালপুরে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিধবা পতœীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, কোনো পাকিস্তানি আজ পর্যন্ত তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পায়নি। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মিসেস সালিমের সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন যে, তার পিতার হত্যাকা-ে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা যাতে ফাঁস হয়ে না যায় সে জন্য মিসেস রাফেলের সঙ্গে তিনিসহ কোনো পাকিস্তানিকে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। ২০০৪ সালের ২ আগস্ট ডেইলি টাইমসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিমান দুর্ঘটনার ছদ্মাবরণে তার পিতাকে পরিকল্পিতভাবে সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র হত্যা করেছে। রুবিনা হক একথাও বলছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাফেল জানতেন যে, তার পিতার সঙ্গে তাকেও প্রাণ দিতে হবে। এ কথা জেনেও রাষ্ট্রদূত রাফেল বিমানে আরোহণ করেন। জিয়াউল হকের আহ্বানে তিনি পাক ওয়ানে চড়তে বাধ্য হন।
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে মার্কিন নৌঘাঁটিতে জাপানি হামলাও এমনি একটি রহস্যময় অধ্যায়। আলোচনা করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র চাইতো পার্ল হারবারে জাপান হামলা চালাক। কেননা যুক্তরাষ্ট্র তখনো ছিল যুদ্ধের বাইরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ওছিলা না। পার্ল হারবারে জাপানি হামলা যুক্তরাষ্ট্র সেই ইপ্সিত সুযোগ দেয়। ১৯৪১ সালে পেরুর রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পার্ল হারবারে জাপানি হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পারে। সকল গোয়েন্দা তথ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে বৈদেশিক হামলা আসন্ন। এ ধরনের ইঙ্গিত পেয়েও আমেরিকা মোটেও উদ্বিগ্ন ছিল না। সকল তথ্য প্রমাণে একথা নিঃসন্দেহ হয়ে যায় যে, পার্ল হারবারে জাপানি হামলা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাঙ্খিত এবং প্রত্যাশিত। এ হামলা আমেরিকাকে একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার এবং জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপের মোক্ষম সুযোগ এনে দেয়।
আইএস বরাবর মুসলিম পরিচয় ব্যবহার করে। তবে মুসলিম পরিচয় ভাঙ্গালেও তাদের প্রতিটি কার্যকলাপে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইসরাইল লাভবান হয়। তারা কখনো দাবি করেনি যে, তারা যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ভারতের পক্ষে কাজ করে। কিন্তু তাদের কার্যকলাপের মোটিভ বলছে যে, তারা হলো মুসলিম বিদ্বেষী শক্তিগুলোর এজেন্ট এবং তাদের এজেন্ডা তারা বাস্তবায়ন করছে। আজ পর্যন্ত কোনো মুসলমান বলছে না যে, তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে মুসলমানরা কোনোভাবে লাভবান হচ্ছে। স্ক্ষূèদৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো হাকিম হয়ে হুকুম করছে এবং ওঝা হয়ে ঝাড়ছে। তারাই সব ঘটন অঘটনের নায়ক। আমরা হলাম দর্শক মাত্র। দুর্বল হলে এমনি হয়। সবাই ফুটবলের মতো লাথি মারতে চায়।