সামুদ্রিক মাছ খাওয়া সুন্নত, জেনে নিন বিস্ময়কর উপকারিতা

মাছের তেলের পুষ্টিগুণ

ডেস্কঃ সমুদ্র যেমন এক মহাবিস্ময় তেমন সমুদ্রের ভেতরকার প্রতিটি প্রাণীও বিস্ময়কর। বিস্ময়ের সীমা নেই সমুদ্রের মাছেও। স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফে সমুদ্র ও গর্ভস্থ মাছ সম্পর্কে বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছেন।

মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ মুবারক করেন,

أُحِلَّ لَكُمۡ صَيۡدُ ٱلۡبَحۡرِ وَطَعَامُهُۥ مَتَٰعٗا لَّكُمۡ وَلِلسَّيَّارَةِۖ ﴾ [المائ‍دة: ٩٦]

“তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য; তোমাদের ও মুসাফিরদের ভোগের জন্য।” [পবিত্র সূরা আল-মায়িদা, পবিত্র আয়াত: ৯৬]

মহান আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ মুবারক করেন,
﴿وَهُوَ ٱلَّذِي سَخَّرَ ٱلۡبَحۡرَ لِتَأۡكُلُواْ مِنۡهُ لَحۡمٗا طَرِيّٗا وَتَسۡتَخۡرِجُواْ مِنۡهُ حِلۡيَةٗ تَلۡبَسُونَهَاۖ وَتَرَى ٱلۡفُلۡكَ مَوَاخِرَ فِيهِ وَلِتَبۡتَغُواْ مِن فَضۡلِهِۦ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ١٤﴾ [النحل: ١٤]
“আর তিনিই সে সত্তা, যিনি সমুদ্রকে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোশত খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার অলংকারাদি, যা তোমরা পরিধান কর। আর তুমি তাতে নৌযান দেখবে তা পানি চিরে চলছে এবং যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পার এবং যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর।” [পবিত্র সূরা আন-নাহল, পবিত্র আয়াত: ১৪]

আয়াত শরীফে মহান আল্লাহ পাক সামুদ্রিক মাছকে তাজা গোশত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

সামুদ্রিক মাছ খাওয়া সুন্নত। আখেরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সামুদ্রিক মাছ খেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার সূত্রে একটি হাদিস শরীফ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনি কুরাইশদের একটি কাফেলাকে পাকড়াও করতে আমাদেরকে এক অভিযানে পাঠালেন। তিনি হযরত আবূ উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনাকে আমাদের সেনাপতি বানালেন। তিনি আমাদের সাথে এক ব্যাগ খেজুরও দিলেন। এছাড়া আর কিছু আমাদের সাথে ছিলো না। আবূ উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনি প্রতিদিন আমাদের প্রত্যেককে একটি করে খেজুর দিতেন। আমরা বাচ্চাদের মতো তা চুষে খেতাম।অতঃপর পানি পান করতাম। এভাবে আমরা রাত পর্যন্ত সারা দিন কাটিয়ে দিতাম। আমরা নিজেদের লাঠি দিয়ে গাছের পাতা ঝরিয়ে তা পানিতে ভিজিয়ে খেয়েছি। হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনি বলেন, আমরা সমুদ্রের কিনারার দিকে অগ্রসর হলাম। অতঃপর সমুদ্রের তীরে বালুর ঢিবির ন্যায় একটি বস্তু দেখা গেলো। আমরা গিয়ে দেখলাম, এটা একটা সামুদ্রিক প্রাণী, যার নাম আম্বর (তিমি) মাছ। হযরত আবূ উবাইদাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনি বললেন, এটা মৃত প্রাণী, আমাদের জন্য হালাল নয়। অতঃপর তিনি মত পাল্টিয়ে বললেন, না! বরং আমরা রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনার প্রতিনিধি এবং আমরা আল্লাহর রাস্তায় বের হয়েছি। তোমরাও সংকটসপন্ন অবস্থায় সম্মুখীন হয়েছ, সুতরাং এটা খাও। জাবির রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনি বলেন, কেবলমাত্র আমরাই সেখানে অবস্থান করেছিলাম। আমরা সংখ্যায় ছিলাম তিনশো। আমরা প্রতিদিন তা খেয়ে মোটাতাজা হয়ে গেলাম। আমরা রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনার নিকট ফিরে এসে উনাকে ঘটনাটি বললাম। তিনি বললেনঃ ওটা ছিলো রিযিক, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য পাঠিয়েছিলেন। তোমাদের সাথে এর গোশত অবশিষ্ট আছে কি? থাকলে আমাকে খাওয়াও। আমরা মাছের কিছু অংশ রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনার নিকট পৌঁছালাম, তিনি তা খেলেন।
[সুনান আবূ দাউদ (৩৮৪০); মুসলিম, নাসায়ী, আহমাদ, হুমাইদী]

মাছ একটি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। আমরা সাধারনত মিঠা পানির মাছ বেশি খেয়ে থাকি। তবে অনেকেরই জানা নেই যে সামুদ্রিক মাছের পুষ্টিগুণ সাধারণ পানির মাছের তুলনায় বেশি। তাই দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয়রোধে এর অসীম ভূমিকা রয়েছে। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে রয়েছে বিস্ময়কর স্বাস্থ্য উপকারিতা। কেনইবা থাকবেনা সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার বিষয়ে স্বয়ং মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাক খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন।

এবার আমরা দেখবো সামুদ্রিক মাছের বিস্ময়কর কিছু উপকারিতা।

বার্ধক্য প্রতিরোধ করে:
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সামুদ্রিক মাছে রয়েছে প্রচুর সিলোনিয়াম যা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে শরীরে কাজ করে ও বার্ধক্য প্রতিরোধ করে।

হার্টের সুরক্ষায় :
চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, মাছের মধ্যে থাকা উপাদানগুলো মানুষের হৃদযন্ত্র কার্যকর ও সুরক্ষিত রাখার জন্য কাজ করে। হৃদযন্ত্র অচল ও অকার্যকর হয়ে যাওয়ার যে ঝুঁকি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয় যেসব কারণে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে মাছের উপাদানগুলো। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক ড. দারিউস মোজাফফারিয়ান বলেন, কেউ যদি নিয়মিত মাঝারি মাছ খান তাহলে তার হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। সারা বিশ্বে পরিচালিত ৩০টি বড় ধরনের গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, যারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার বা দুইবার মাছ খান তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি গড়ে ৩৬ শতাংশ কমে যায় বলে ড. মোজাফফারিয়ান জানান।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রকে সক্রিয় ও কার্যক্ষম রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এ মূল্যবান উপাদানের শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক উৎস হচ্ছে মাছের তেল। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রের রিদম বা ছন্দকে দ্রুততর করে, ধমনীতে চর্বি জমার মাত্রাকে কমিয়ে দেয়, ধমনীতে পুরনো প্রদাহকে ঠাণ্ডা রাখতে সহায়তা করে ও রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

মস্তিষ্কের সুরক্ষায়:
সামুদ্রিক মাছ কেবল আপনার হৃদযন্ত্রের জন্যই উপকারী নয়, এটা আপনার মস্তিষ্ককেও সুরক্ষা দিয়ে থাকে। যারা সামুদ্রিক মাছ বেশি খান তাদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এ কমে যাওয়ার হার প্রায় ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করে থাকে।

চর্মরোগে উপকারি:
সামুদ্রিক মাছের মধ্যে এমন বিশেষ ধরণের উপাদান আছে, যা খেলে শরীরের চামড়ায় খুজলী-পাঁচড়াসহ অন্যান্য কোন চর্মরোগ হয় না, ত্বক রোগমুক্ত ও সজীব থাকে।

বুদ্ধির বিকাশ:
২০০৭ সালে প্রায় ১২ হাজার গর্ভবতী নারীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, যেসব নারী তাদের গর্ভকালীন সপ্তাহে অন্তত ৩৪০ গ্রাম সামুদ্রিক খাবার খেয়েছেন তাদের সন্তানের বুদ্ধি যেসব নারী অন্য ধরনের খাবার খেয়েছেন তাদের সন্তানের বুদ্ধির চেয়ে ছয় গুণ বেশি। বয়স্কদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। সম্প্রতি একটি সুইডিশ গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব যুবক সপ্তাহে একাধিকবার সামুদ্রিক মাছ খান তাদের বুদ্ধি যারা সচরাচর সামুদ্রিক খাবার খান না তাদের চেয়ে ১১ গুণ বেশি।

ডিমেনশিয়া (বয়ষ্কদের ভুলে যাওয়া রোগ):
যারা সামুদ্রিক মাছ বেশি খান তাদের শেষ বয়সে ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও অনেকাংশে কমে যায়।

মনমরাভাব দূর হয়:
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, যারা নিয়মিত সামুদ্রিক খাবার খান (সরাসরি খাদ্য হিসেবে কিংবা পরিপূরক হিসেবে) তাদের শরীর সুস্থ থাকার পাশাপাশি বিপদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব দূরীভূত হয়। এর কারণ, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের দু’টি প্রধান রাসায়নিক উপাদান সেরোটোনিন ও ডুপামাইনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ দু’টি উপাদানের মাত্রা বা পরিমাণ কম থাকলেই মানসিক বিষাদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব সৃষ্টি হয়।

কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে:
সামুদ্রিক মাছে ভিটামিন ‘এ’ এবং ‘ডি’ থাকে, যা কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। হৃদরোগে আক্রান্ত ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সামুদ্রিক মাছ খুবই উপকারী।

কিছু পরিচিত সামুদ্রিক মাছের নাম-
রূপচাঁদা, ইলিশ মাছ, ফলিচান্দা, ট্যাঁকচান্দা, উড়ুক্কু মাছ/পাখি মাছ, লইট্টা মাছ, মাইট্যা মাছ, কালো পোয়া, সাদা পোয়া, সোনালী বাটা, শিলন মাছ, কোরাল, রাঙা কই, সামুদ্রিক চিংড়ি, কামিলে মাছ, ছুরি মাছ, টুনা মাছ, নানচিল কোরাল, ভেটকি মাছ, মেঘা ওলুয়া, সামুদ্রিক লবস্টার, ক্যাট ফিশ, গোট ফিশ ইত্যাদি।