যে যুক্তিতে ঐশীর মৃত্যুদণ্ড বাতিল হলো

বাবা-মা হত্যায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ঐশী রহমানকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ মামলার আপিল, জেল আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে গতকাল বিচারক জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারক জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। ঐশীর আইনজীবী এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন। এর আগে শুনানি শেষে ৭ মে থেকে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) ছিল। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহুরুল হক জহির ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল হক সেলিম। ঐশীর পক্ষে ছিলো আইনজীবী আফজাল এইচ খান ও সুজিত চ্যাটার্জি।
আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সভ্য দেশগুলো মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না। দিনের পর দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সে হিসেবে মানুষ সভ্য হয়ে ওঠেনি। প্রাথমিক শিক্ষিত থেকে উচ্চশিক্ষিত সব স্তরেই অপরাধের প্রবণতা বেড়ে গেছে। বিচার বাস্তবতায় আমাদের দেশের ফাঁসির দণ্ড বাতিল করার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের দেশ এখনো সভ্য দেশগুলোর মতো সেই পরিমাণ উন্নত হয়নি। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ঐশী রহমানের দণ্ড কমাতে তার পক্ষের আইনজীবীরা বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষও নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরেছে। সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেখা যায়, একজন সন্তান কর্তৃক বাবা-মা হত্যাকাণ্ড সামাজিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছু নয়। তবে ঐশী রহমানের মানসিক পরীক্ষা এবং ডাক্তারি সনদের পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের সময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর। ঐশীর মামা, দাদি মানসিক রোগী ছিলেন।
পরীক্ষাকালে জানা যায়, ১৪ বছর বয়স থেকেই ঐশী রহমান সিসা, অ্যালকোহল, গাঁজা ও ইয়াবা সেবন করতেন। এ কারণে তিনি ছিল আশাহীন ও সাহায্যহীন। এবং আদালতের কাছে তিনি বলেছেন, বাবা-মাকে হত্যার পর এ বিষয়ে তার কোনো অনুশোচনা নেই। পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ঐশী রহমানের বাবা ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা ছিলেন একটি প্রাইভেট কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাবা-মা দুজনই ব্যস্ত থাকায় তিনি ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত। বাবা-মায়ের উচিত ছিল সন্তানকে সময় দেওয়া। বাবা-মা সময় না দেওয়ায় তিনি সচেতনতা ও সুশাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এবং ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ঐশী রহমান অ্যাজমা ও মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এবং ঘটনার পর আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ইতিপূর্বে তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অপরাধ নেই। এসব বিবেচনায় নিয়ে ঐশী রহমানকে আমরা ৩০২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেছি। কিন্তু সাজার ক্ষেত্র বিবেচনা করে যাবজ্জীবন দণ্ড প্রদান করা হলো। বিচারিক আদালত রায় দেওয়ার সময় আবেগতাড়িত ছিলেন উল্লেখ করে উচ্চ আদালত বলেছেন, রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে আবেগতাড়িত হওয়া সমীচীন নয়।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে এই দম্পতির একমাত্র কন্যা ঐশী রহমানকে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর পলাতক ঐশীকে আশ্রয় দেওয়ায় তার বন্ধু মিজানুর রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার অপর আসামি আসাদুজ্জামান জনিকে খালাস দেন আদালত। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর হাই কোর্টে ঐশী আপিল ও জেল আপিল করেন। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হিসেবেও মামলাটি হাই কোর্টে আসে। বিচারিক আদালতে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে দণ্ড কার্যকরে হাই কোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ‘ডেথ রেফারেন্স’ মামলা হিসেবে পরিচিত। রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগে সপরিবারে থাকতেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (পলিটিক্যাল শাখা) ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান। ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট ওই বাসা থেকে স্ত্রী স্বপ্না রহমানসহ তার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত মাহফুজুর রহমানের ভাই মশিউর রহমান ওই দিনই পল্টন থানায় হত্যা মামলা করেন। হত্যাকাণ্ডের পরদিন নিহত দম্পতির মেয়ে ঐশী রহমান গৃহকর্মী সুমীকে নিয়ে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ ঐশী ও তার দুই বন্ধুর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র এবং নিহতদের বাসার শিশু গৃহকর্মী সুমীর বিরুদ্ধে শিশু আইনে পৃথক অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। বিচারিক আদালত ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় গৃহকর্মী সুমীর বিচার চলছে শিশু আদালতে।