কারাগারেই মরতে হবে সাঈদীকে

মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গেলেও জীবদ্দশায় এই স্বাধীনতাবিরোধী নেতা বের হতে পারবেন না। তাকে বাকি জীবন জেলেই কাটাতে হবে। আপিল বিভাগের রায় বহাল থাকায় খালাস আর ফাঁসি কোনোটিই হল না সাঈদীর।

সাঈদীর ফাঁসি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আর আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় থেকে খালাস চেয়ে আসামিপক্ষের রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ায় মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল। এখন আর কোনো আইনি ধাপ কার্যকর নেই।

জামায়াত নেতা সাঈদীর ফাঁসি না হওয়ায় হাতাশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, ‘আমরা তো এটা চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম তার ফাঁসি। এই মামলায় আমরা ন্যায়বিচার পাইনি।’

আইনি ব্যাখ্যায় সাঈদীর সর্বোচ্চ দণ্ডই হয়েছে। আইন অনুযায়ী এই সর্বোচ্চ দণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড। এর মধ্যে আপিল বিভাগ বেছে নিয়েছে প্রথমটি। আর এই যাবজ্জীবন দণ্ড মানে যে তারে জীবদ্দশায় আর বের হতে দেয়া হবে না, সেটা ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের রায়ে স্পষ্ট করা হয়।

সাঈদীর আপিলের রায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করায় সাঈদীকে ‘যাবজ্জীবন’ কারাদণ্ড দেয়া হয়। যাবজ্জীবন বলতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় পর্যন্ত’ কারাবাস বোঝাবে বলে ব্যাখ্যা দেয় আদালত।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ জানান, ‘আপিল বিভাগের রায়ে স্পষ্ট বলা আছে- সাঈদীর রায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড মানে লাইফ টাইম ইমপ্রিজনমেন্ট। অর্থাৎ আমৃত্যু তাকে কারাগারে থাকতে হবে।’

এছাড়া হত্যা, লুটপাটের একটি অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অন্য একটি অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।

এর আগে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালি নামে দুই জনকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর ফাঁসির রায় দিয়েছিল। তবে চূড়ান্ত বিচারে তা টেকেনি।

৭৭ বছর বয়সী সাঈদী বর্তমানে আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। ২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে তিনি কারাবন্দী।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসাবে জামায়াতের নায়েবে আমির সাঈদীর বিচার শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর।

মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে একাত্তরে জামায়াত নেতা সাঈদীকে পিরোজপুরের মানুষ চিনত ‘দেইল্লা রাজাকার’ নামে। সে সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় তিনি অংশ নিয়েছিলেন, তা উঠে এসেছে এ মামলার বিচারে।

বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়।

ওই রায়ের পর দেশজুড়ে সহিংসতা চালায় জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। ওই তাণ্ডবে প্রথম তিন দিনেই নিহত হন অন্তত ৭০ জন। এছাড়া বহু গাড়ি-দোকানপাট ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হিন্দুদের মন্দির-ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়।

এরপর সাঈদী আপিল করলে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনসহপাঁচ বিচারকের আপিল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেয়। তাতে সাজা কমে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ আসে।

একাত্তরের ‘দেইল্যা রাজাকারের’ সাজা কমানোর রায়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও গণজাগরণ মঞ্চসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শাহবাগে সে সময় শ্লোগান ওঠে – ‘আঁতাতের এই রায় মানি না, প্রহসনের এই রায় মানি না।’

২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি সাঈদীর ফাঁসি চেয়ে রিভিউ আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। পাঁচ দিনের মাথায় খালাস চেয়ে আবেদন করেন সাঈদী।