মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আরো কঠোর হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ঢাকা: মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। ক্যাশ-ইনের (জমা) সর্বোচ্চ সীমা যেমন কমেছে, একইভাবে কমানো হয়েছে ক্যাশ-আউটের (উত্তোলন) সীমাও। সীমিত করে আনা হয়েছে দৈনিক ও মাসিক লেনদেনের (ট্রানজেকশন) সর্বোচ্চ সংখ্যাও।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর আরো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে গতকাল লেনদেন সীমা কমিয়ে আনার নির্দেশনাসংবলিত একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাৎক্ষণিকভাবে পরিপালনের নির্দেশনা দিয়ে গতকালই সার্কুলারের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোয় পাঠানো হয়েছে।

লেনদেন সীমা কমিয়ে আনার কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, কিছু অসাধু ব্যক্তি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা অপব্যবহার করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের অপব্যবহার রোধকল্পে এবং এর সুশৃঙ্খল ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই লেনদেনের এ নতুন সীমা আরোপ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একজন গ্রাহক দৈনিক সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা জমা করতে পারবেন। দৈনিক সর্বোচ্চ দুবারে তিনি এ অর্থ জমা দেয়ার সুযোগ পাবেন। আর একজন গ্রাহক মাসে জমা দিতে পারবেন সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা। মাসে সর্বোচ্চ ২০ বারে এ অর্থ জমা দিতে পারবেন তিনি।

আগের নির্দেশনায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একজন গ্রাহক দৈনিক সর্বোচ্চ পাঁচবারে ২৫ হাজার টাকা জমা দিতে পারতেন। মাসে জমা দেয়ার সুযোগ ছিল সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ ২০ বারে এ টাকা জমা দেয়া যেত।

জমার পাশাপাশি কমিয়ে আনা হয়েছে উত্তোলনের সর্বোচ্চ সীমাও। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন গ্রাহক দৈনিক সর্বোচ্চ দুবারে ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। আর মাসে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করা যাবে মোট ১০ বারে। যদিও আগের নীতিমালা অনুযায়ী একজন গ্রাহক দৈনিক সর্বোচ্চ তিনবারে ২৫ হাজার টাকা উত্তোলন করতে পারতেন। আর মাসে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলনের সুযোগ ছিল ১০ বারে।

নতুন নীতিমালায় মোবাইল হিসাবে টাকা জমা হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই হিসাব থেকে ৫ হাজার টাকার বেশি নগদ উত্তোলনের সুযোগ রাখা হয়নি। তবে পি-টু-পি পদ্ধতিতে অর্থ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত সীমা অর্থাৎ প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১০ হাজার ও মাসে মোট ২৫ হাজার টাকা লেনদেনের নির্দেশনা বহাল রাখা হয়েছে। এছাড়া নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো মোবাইল হিসাবে ৫ হাজার টাকা বা তদূর্ধ্ব নগদ অর্থ জমা অথবা উত্তোলন করার ক্ষেত্রে গ্রাহককে তার পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ড কিংবা তার ফটোকপি এজেন্টকে দেখাতে হবে।

২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করার পর নতুন ধারার এ ব্যাংকিং শুরু হয়। ওই বছরই দেশে প্রথম মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। একই বছর কার্যক্রমে আসে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’। এরপর ২০১২ সালে বেসরকারি খাতের ইউসিবি ‘ইউ-ক্যাশ’ ও ইসলামী ব্যাংক নিয়ে আসে ‘এম-ক্যাশ’। ২০১৩ সালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের জন্য পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ায় ওই বছরই মার্কেন্টাইল ব্যাংক ‘মাই-ক্যাশ’ ও ওয়ান ব্যাংক ‘ওকে ব্যাংক’ নামে সেবাটি চালু করে। একই বছর আইএফআইসি ব্যাংকও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। এখন ১৮টি ব্যাংক এ সেবার সঙ্গে যুক্ত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগ থেকে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবার বিষয়ে নতুন এ নির্দেশনার অনুলিপি গতকালই মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবা দানকারী সব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মুহম্মদ শিরিন এ প্রসঙ্গে বলেন, মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন কমানোর জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন শর্ত যুক্ত করেছে। এদিক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু নতুন শর্তের ফলে দেশের ছোট ব্যবসায়ী ও প্রকৃত গ্রাহকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওটিসি মার্কেটে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের লেনদেনের পরিমাণ খুবই কম। এ কারণে আমাদের ব্যাংকের লেনদেনের ওপর এর প্রভাব খুব বেশি পড়বে না।

লেনদেনের সীমা কমিয়ে আনার পাশাপাশি আরো কিছু নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সার্কুলারে। এতে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কোনো মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাধিক হিসাব (মোবাইল) চালু রাখতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে কোনো গ্রাহকের একই জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ড কিংবা অন্য কোনো পরিচয়পত্রের বিপরীতে একই প্রতিষ্ঠানে একাধিক মোবাইল হিসাব থাকলে যেকোনো একটি হিসাব চালু রেখে অন্যগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। তবে যেসব মোবাইল হিসাব বন্ধ করা হবে, তার সমুদয় স্থিতি সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে পরিশোধ বা প্রদান কিংবা হস্তান্তরের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

এছাড়া গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে এজেন্টকে। গ্রাহকের মোবাইল হিসাবে নগদ অর্থ জমা ও উত্তোলনের বিবরণও পৃথক রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করবেন তিনি। এছাড়া লিপিবদ্ধ প্রত্যেকটি লেনদেনের বিপরীতে গ্রাহকের স্বাক্ষর বা টিপসই সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো এজেন্টের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তার এজেন্সিশিপ বাতিল হবে। সে লক্ষ্যে জোরদার করতে হবে এজেন্টদের ওপর সংশ্লিষ্ট মেবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের নজরদারি। তাছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর গৃহীত পদক্ষেপ মাসিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরবর্তী মাসের ৭ তারিখের মধ্যে পাঠাতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অবাঞ্ছিত লেনদেন বন্ধ করতেই লেনদেনের সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। মোবাইল অ্যাকাউন্টে গ্রাহকরা কেনাকাটাসহ বিভিন্ন বিল পরিশোধ করার জন্য ক্যাশ-ইন করেন। কিন্তু এর মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন হতে দেখা যায়। অনেকের বিরুদ্ধে বিদেশে ভুয়া এজেন্ট সৃষ্টি করে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। ক্যাশ-ইন করার পর যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্যাশ-আউট করতে না পরে, তাহলে হুন্ডির তত্পরতা কমে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গত বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৪০ হাজার। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সারা দেশে ৬৭ হাজার এজেন্টের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সিংহভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’ ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ‘রকেট’।