রিভিউ খারিজ: রাজাকার মীর কাসেমের সামনে ফাঁসির দড়ি

Image result for ফাঁসির দড়ি

ঢাকা: ধর্মব্যবসায়ী জামাত নেতা রাজাকার মীর কাসেম আলীর মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। ফলে তার মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রয়েছে। প্রধান বিচারক সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ আপিল বিভাগের ১নং বিচার কক্ষে জনাকীর্ণ আদালতে আজ সকাল ৯টায় এ আদেশ দেয়। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলো- বিচারক সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারক হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারক মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারক মোহাম্মদ বজলুর রহমান।

গত ২৮ আগস্ট-২০১৬ আসামী ও রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি শেষে রিভিউ আবেদনের উপর আজ আদেশ দেয়ার দিন ধার্য করেছিল। গত ২৪ আগস্ট-২০১৬ আসামীপক্ষে আনা সময় আবেদন নাকচ করে দিয়ে মীর কাসেম আলীর আইনজীবীকে ওই দিন শুনানি শুরুর নির্দেশ দেয় প্রধান বিচারক। এরপর গত ২৮ আগস্ট-২০১৬ বিষয়টির উপর মীর কাসেমের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি করেন। আসামীপক্ষের শুনানির বিপরীতে যুক্তি পেশ করেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

যে অভিযোগে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডাদেশ হয়েছে তা সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়নি দাবি করে রায় রিভিউর আবেদন পেশ করে আসামীপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। অপরদিকে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আসামী মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি পেশ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আল-বাদর নেতা মীর কাসেম আলী চট্টগ্রামে টর্চার সেল ডালিম হোটেলের মূলহোতা ছিলো উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা কিশোর জসিম হত্যায় এ আসামীর সম্পৃক্ততা বিষয়ে দেয়া সাক্ষীদের সাক্ষ্য তুলে ধরেন। এটর্নি জেনারেল আসামীপক্ষে আনা রিভিউ আবেদন খারিজ করে রায় বহাল রাখতে আর্জি পেশ করেছিলেন।

আজ রিভিউ আদেশ পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এটর্নি জেনারেল সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, এ রায় যুগান্তকারী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আল-বাদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায়, তা ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রমাণিত হয়। আপিলের রায় ও এ রায় রিভিউ আবেদনেও তা প্রমাণিত হয়েছে বলে জানান এটর্নি জেনারেল।

গত ৮ মার্চ-২০১৬ মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত রায় রায় ঘোষণা করেছিলো আপিল বিভাগ। গত ৬ জুন-২০১৬ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এর আগে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মীর কাশেম আলীকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল।

আপিলের রায়ে বলা হয়, আসামিপক্ষে আনা আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হয়েছে। এ মামলায় প্রসিকিউশন আনীত অভিযোগের মধ্যে ৪, ৬ ও ১২নং অভিযোগ থেকে মীর কাশেম আলীকে খালাস এবং ২, ৩, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালে দেয়া দন্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ। একটি অভিযোগে তার মৃত্যুদন্ড বহাল এবং অপর ছয় অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদন্ডের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

যে অভিযোগে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড আপিলেও বহাল রাখা হয়:

মুক্তিযুদ্ধকালে ঈদুল ফিতরের পরে একদিন রাজাকার মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আল-বাদর বাহিনীর সদস্যরা চট্রগ্রাম শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে শহরের আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিম মৃত্যুবরণ করলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

গত ১৯ জুন-২০১৬ আপিল বিভাগের ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করে মীর কাসেম আলী। ওই আবেদনে ১৪টি আইনগত যুক্তি তুলে ধরে তাকে বেকসুর খালাস দেয়ার আবেদন জানানো হয়। জামাতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে দেয়া আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ৬ জুন-২০১৬ প্রকাশ করা হয়। রাজাকার মীর কাসেমের আপিল মামলায় রায় প্রদানকারী প্রধান বিচারক সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারকের আপিল বেঞ্চ রায়ে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশিত হয়। এটি আপিলে সপ্তম মামলা ও রিভিউ আবেদনের ষষ্ঠ মামলা যার চুড়ান্ত রায় হলো। মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের আদেশে ২০১২ সালের ১৭ জুন রাজাকাপর মীর কাশেম আলীকে গ্রেফতার করা হয়। সে থেকে সে কারাগারে রয়েছে।

সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবারের সন্তোষ:
যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড বহাল থাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এই রায়ের মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। দেয়া প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ বীরউত্তম বলেন, সত্য একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই। এই রায়ের মধ্য দিয়ে তা প্রমানিত হয়েছে। অন্যায়ের বিচার হয়েছে এবং বাংলাদেশ ন্যায় বিচার পেয়েছে। এখন আমরা দন্ড কার্যকরের অপেক্ষায় রয়েছি। কারণ মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।

এ্যাটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এই রায়ে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান হয়েছে। এই রায় শহীদ পরিবারের জন্য স্বস্তিদায়ক। রায়ের মধ্য দিয়ে জাতির আকাঙ্খা পূরণ হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘আইনজীবী হিসেবে এই মামলা পরিচালনার সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। সুতরাং রায় কি হবে তা নিয়ে উদ্বেগে থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল।’

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব সিনিয়র সাংবাদিক হারুন হাবীব বলেন, এই রায় বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন বিজয়। এটি একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় রায়। কারণ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে একাত্তরের এই গণহত্যাকারী যেভাবে বিদেশে লবিষ্ট নিয়োগ করেছিল এবং দেশে-বিদেশে যে চক্রান্ত করেছে রায়ের মধ্য দিয়ে আজ তার অবসান হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সাহসিকতার সাথে এই বিচারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তার স্থান ইতিহাস নির্ধারণ করবে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহারিয়ার কবীর বলেন, এই রায় প্রত্যাশিত ছিল। যা প্রত্যাশিত ছিল সেটিই হয়েছে। এই রায়টি ছিল বহুল আলোচিত একটি রায়। রায়কে বান্চাল ও বিলম্বিত করতে মীর কাসেম আলী তার টাকার পাহাড় ব্যবহার করে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সাহস ও একাগ্রতা না থাকলে এই বিচার কখনো সম্ভব ছিল না। তিনি কোন চাপের কাছে মাথানত না করে বিচার চালিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ডা. আলিম চৌধুরীর স্ত্রী শহীদ জায়া শ্যমলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘এই রায়ে আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি। আমরা উপযুক্ত বিচার পেয়েছি।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে জামাত নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল আদেশ একটি অসাধারণ মুহূর্ত।’