ইসলামি স্থাপত্য শিল্পের কিছু আশ্চর্য নিদর্শন

আধুনিক সভ্যতার গোড়া পত্তন করেন ‍মুসলিম মনিষীগণ। স্থাপত্য শিল্পের গোড়া পত্তন ও আধুনিকায়নেও মুসলিম স্থপতি ও ভাস্করদেরই শতভাগ অবদান। যুগে যুগে তারা তাদের উৎকর্ষতার প্রমাণ বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে আসছেন। মুসলিম স্থাপনাশৈলীর তেমনি কিছু নিদর্শন সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক, যা কালের বিবর্তনে শুধু টিকেই থাকেনি বরং গৌরবভরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে আছে।

তাজমহল
১৬৩১ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সর্বাপেক্ষা প্রিয় স্ত্রী মমতাজ বেগম তাদের ১৪তম সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুবরণ করেন। শোকে মুহ্যমান সম্রাট তার প্রিয় স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা নিদর্শন স্মরূপ এক অমর স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তারই ফলাফল হল বর্তমানের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম একটি তাজমহল।

taj mahal

যমুনা নদীর দক্ষিণ তীরে, ইসলামি স্থাপনাশিল্পের গৌরব তাজমহল নির্মাণে ২০ বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল। এই অসাধারণ স্মৃতিস্তম্ভ তার আকার এবং গঠন দুটি দিক থেকেই তাৎর্যপূর্ণ। প্রধান গম্বুজটি মাটি থেকে ২৪০ ফুট উচুতে অবস্থিত, কারুকার্যের দিক থেকে ভারতীয়, পারসীয় ও ইসলামি সংস্কৃতির অনুসরণ করা হয়েছে।

প্রধান সমাধির শ্বেত পাথর দর্শকমাত্রই মুগ্ধ করবে এবং দেখে মনে হয় দিনের বিভিন্ন সময় এই সমাধির রঙ পরিবর্তন হয়। অনেকে বলে থাকেন, সম্রাট শাহজাহান যমুনা নদীর অপর পাশে কালো গ্রানাইট পাথরের একই রকমের আরো একটি তাজমহল নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের সমাধির ওপর লর্ড কার্জনে উপহার দেয়া বাতি
সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের সমাধি

আল হামরা
স্পেনের গ্রানাডা শহরে অবস্থিত আল হামরা প্রাসাদ ১৩শ শতাব্দীর মধ্যভাগে নাসরি রাজবংশের সময় তৈরি করা হয়। মুহাম্মদ ইবনে নাসর নাসরি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। কালের বিবর্তনে আলহামরা প্রাসাদের কিছু অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপরও তিনটি অংশ এখনও বিদ্যমান রয়েছে- একটি দূর্গ নাম আল কাসবা। যা পাহাড়ের পশ্চিম পার্শ্বের শেষভাগে অবস্থিত; রাজার আবাসভূমি পূর্ব পাশে এবং একটি বাগান যা জেনেরালাইফ নামে পরিচিত।

আলহামরা প্রসাদের প্রাঙ্গন ও রুমগুলো রঙিন টাইলস ও বিভিন্ন ধরনের পাথর দ্বারা খচিত। দেয়ালে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির অপরুপ সৌন্দর্য বিদ্যমান। আলহামরা প্রাসাদটি মহাপরিকল্পনা করে করা হয়নি। এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময় করা হয়। তাই এর পূর্ণাঙ্গ গঠন প্রনালী সমকোণীয় নয়।

১৯৮৪ সালের ২ নভেম্বর ইউনেস্কো আল হামরাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করে।

ইসফাহানের জামে মসজিদ
ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইস্ফাহানের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্য বিষয়ক গৌরবের অন্যতম। বর্তমান মসজিদটির পুরোধা হলো সেলজুক শাসনামলে তৈরি দুই গম্বুজ বিশিষ্ট একটি স্থাপনা। ১২শ শতাব্দীতে এই মসজিদটি পুননির্মাণ করা হয়।

আইওয়ান ধাঁচে নির্মিত এর গঠন প্রনালী হলো চারকোনা বিশিষ্ট একটা প্রাঙ্গনের প্রতি পার্শ্বে একটি করে বড় খিলান করা দরজা যা বিপরীত পার্শ্বের দরজার দিক সরাসরি মুখ করে থাকবে। ইস্ফাহানের জামে মসজিদের এই বৈশিষ্ট্য পরবর্তীতে ইরানের সকল মসজিদের বৈশিষ্ট্য হয়ে পড়ে। ইউনেস্কো ২০১২ সালে এই মসজিদটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করে।

বায়তুল মুকাদ্দাস
মুসলমানদের প্রথম কিবলা ছিলো বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদ। ইসলামী স্থাপনার প্রাচীন নমুনাটি মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছেও সমানভাবে পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ন। আরবদের জেরুজালেম বিজয়ের ৫৫ বছর পর ৬৯১ সালে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। বাইজেনটাইন স্থাপত্য ঐতিহ্যের সাথে মুসলিম স্থাপত্য শৈলীর চমংকার অভিযোজন ঘটেছে এই মসজিদটি নির্মাণে।

Al-Aqsa_Mosque

মুসলিম ইতিহাসের অনেক ঐতিহ্যের সাক্ষী বর্তমানের এই মসজিদ তৈরির স্থানটি। ইসলাম ধর্মমতে, শেষ নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মিরাজে গমনের পূর্বে পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে এই আল আকসা মসজিদে আসেন এবং এখান থেকে তিনি বোররাক নামক জান্নাতি বাহনে সোয়ার হয়ে উদ্র্ধগমন করেন তথা পবিত্র মিরাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উনার সাথে পূর্ববর্তী সকল নবী রাসূল আলাইহিমুস সালামগণ সাক্ষাত লাভে ধন্য হন। উনার ইমামতিতে সকল নবী রসূলগণ নামাজ আদায় করেন। সেখানে হযরত জীবরীল আলাইহিস সালাম তিনি খিদমত করেন এবং জান্নাত-জাহান্নাম পর্যবেক্ষণ করান। শেষে সপ্তম আসমানে মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে একান্ত দীদার লাভ হয়, যা পবিত্র কোরআন শরীফে বর্ণিত রয়েছে।

সামারার বিখ্যাত মসজিদ

আব্বাসিয় খলিফা আল মুতাওয়াককিল এর সময় ইরাকের বিখ্যাত সামারার শহরে এই মসজিদটি আনুমানিক ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের সময় পর্যন্ত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মসজিদ ছিল এটি।

পোড়া ইট দিয়ে শঙ্খিলভাবে নির্মিত এই মসজিদটি ১২৫৮ সালে মঙ্গলীয়দের আক্রমণের সময় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কিন্তু অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ১৭০ ফুট উঁচু মিনারটি টিকে যায়। মিনারটি কৌনিক গঠনে নির্মাণ করা হয় এবং এর চারপাশে শঙ্খিল প্যাঁচানো সিঁড়ি রয়েছে, যা দিয়ে মিনারের ওপরে ওঠা সম্ভব।

কর্ডোবার বিখ্যাত মসজিদ


স্পেনের কর্ডোবার বিখ্যাত মসজিদটি মুসলিম স্থাপনাশৈলির সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। বর্তমানের স্থাপনাটি অনেক উঁচুমানের স্থাপত্যবিদ্যার পরিচয় বহন করে। ইতিহাসবেত্তারা মনে করেন, রোমান দেবতা জেনাসের মন্দির হিসেবে বিল্ডিংটি তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে এই মন্দিরকে চার্চে রুপান্তরিত করা হয়। মুসলিম শাসনামলে এই চার্চকে আবার মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়।

এই মসজিদটির অন্যতম চিত্তাকর্ষক স্থানটি হলো প্রার্থনার জায়গাটি। প্রার্থনার জায়গাটি হাইপোস্টাইল (অর্থাৎ কলাম দিয়ে পূর্ণ) ধাঁচে তৈরি।