‘দেইল্যা রাজাকার’ যখন আল্লামা সাঈদী

ডেস্ক: একাত্তরে পিরোজপুরের দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ওরফে ‘রাজাকার দেইল্যা’ স্বাধীনতার পর জনগণকে ধর্মকর্মের কথা শুনিয়ে ‘আল্লামা সাঈদী’ হলেও তার অধর্মের অপকর্মের কলঙ্ক এখনো মুছে যায়নি। এখনো সাঈদীরা একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী দালাল-ঘাতক-রাহাজানির নির্মমতা।  নৃশংসতার ভয়ঙ্কর প্রতীক।

একাত্তরের কুখ্যাত ঘাতক রাজাকার দেইল্যা সাঈদী সে জামাতের মজলিসে শূরার এক সদস্য। সে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী লাদেনের এক ভাবশিষ্য। বাংলাদেশে তালেবানী স্টাইলে ক্ষমতা দখলের অলীক স্বপ্ন যারা দেখে, তাদের একজন এই রাজাকার সাঈদী। জাতির দুর্ভাগ্য, সাঈদী সগর্বে ঘোষণা করে, তাকে রাজাকার প্রমাণ করতে পারলে সে সংসদ থেকে পদত্যাগ করবে। এমন দুঃস্পর্ধার পরও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবিদার বর্তমান সরকার (২০০১ ক্ষমতায় থাকা আ’লীগ সরকার) তার বিরুদ্ধে কোনো তদন্তের উদ্যোগ নেয়নি; কিন্তু পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধা বয়েজউদ্দিন পশারী ও পারেরহাট ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন গাজী তার চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ধুরন্ধর ধর্মব্যবসায়ী সাঈদী সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সাড়া দেয়নি।
ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির যুদ্ধাপরাধীর তালিকায়ও সাঈদীর নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এমন অভিযোগও রয়েছে, সাঈদী একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এত বেশি তৎপর ছিল যে, বিজয়ের প্রাক্কালে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও আব্দুল আজিজ নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিল। তদন্ত করলে এ ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাবে।
সরেজমিনে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকী সেনাদের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের তুলে দেয়া, হত্যা, দোকানপাট, বাড়িঘর লুটপাট, নির্যাতন-নিপীড়নে ‘দেইল্যা’ নামে পরিচিত রাজাকার সাঈদীর অপকর্মাদি নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা হলেও পাড়েরহাটের বাসিন্দারা আজও তা ভোলেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধই সউদখালী গ্রামের ইউসুফ আলী সিকদারের পুত্র দেলওায়ার হোসেন ওরফে দেইল্যার ভাগ্যকে বদলে দিয়েছে। যুদ্ধ শুরুর আগে এই দেইল্যা ছিল পাড়েরহাটের বাদুরা গ্রামের ইউনুস মুন্সীর ‘আশ্রিত’। শ্বশুরালয়ে থাকা দেইল্যা ছিল বেকার। একটি মুদি দোকানে বসে আড্ডা দিতো।
স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে দেইল্যা সাঈদী রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখায়। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ব্যক্তি ও পরিবারের উপর নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতায় সে এত ভয়ঙ্কর ছিল যে, অচিরেই পাকী সেনাদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠে। তাকে তিনশ’ সদস্যের এক রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া হয়। জোর করে তরুণদের ধরে এনে রাজাকার ও আল-বাদর বহিনীতে নাম লেখাতে বাধ্য করতো সাঈদী। কেউ রাজাকার বা আল-বাদর না হতে চাইলে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ সময় সে রাজাকার ও শান্তিকমিটির নেতা মলানা দানেশ মোল্লা, মোছলেম মলানা ও সেকান্দার সিকদারের নৈকট্য লাভ করে। পরবর্তীতে পিরোজপুর মহকুমার রাজাকারপ্রধান মাণিক খোন্দকার তাকে আল-বাদর বাহিনী গঠনের দায়িত্ব দেয়। রাজাকার সাঈদী তার চার রাজাকার সঙ্গীকে নিয়ে গঠন করে এক যৌথ তহবিল, যা পরিচিত ছিল ‘পাঁচ তহবিল’ নামে। লুটের মালকে তারা গণিমতের মাল বলে আখ্যায়িত করত এবং পাঁচজনের মধ্যে ভাগাভাগি হত। যুদ্ধকালীন পাড়েরহাট বন্দরে সাঈদী তার অধীনস্থ রাজাকার ও আল-বাদরদের নিয়ে হেলালউদ্দিন পশারী, সইজউদ্দিন পশারী, রইজউদ্দিন পশারী, আমজাদ গাজির বাড়িসহ অর্ধশতাধিক দোকান লুট করে। পাড়েরহাট খেয়া সংলগ্ন সুলতান তালুকদারের ঘর দখল করে মুদি মনোহরী দোকান নিজের নামেই চালু করে।
একাত্তরে জুন মাসে বন্দরের উত্তর প্রান্তের মদনমোহনের বৃহৎ ও সুদৃশ্য বাড়িটি লুটপাটের পর ভেঙ্গে সাঈদী সেটি নিজ বাড়িতেই নিয়ে আসে। আগস্ট মাসের গোড়ার দিকে এক মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে তাকে সে পাকী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়।
এছাড়া রাজাকার সাঈদী বন্দরের ব্যবসায়ী নারায়ণ সাহা, বিপদ সাহা, মাখন সাহাসহ আরো কয়েক বণিকের দোকান লুট করে। লুণ্ঠনের পাশাপাশি বহু ঘরবাড়ি পোড়ানো, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করে পাকী বাহিনীকে দেয়া ও তাদের মাতাপিতাসহ আত্মীয়স্বজনকে হয়রানি, নির্যাতন ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অনেক অভিযোগ রয়েছে- যা সরকার তদন্ত করলে এখনো বিস্তারিতভাবে জানা যাবে। এই রাজাকার সাঈদীর বিরুদ্ধে জঘন্যতম অভিযোগ, পাকী বাহিনীর ভোগের জন্য বলপূর্বক মেয়েদের ধরে সে তাদের ক্যাম্পে পাঠাতো।
১৯৯৭ সালে সাঈদী সগর্বে বলেছে, আমি মানুষ মেরে থাকলে আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলো না কেন?
রাজাকার সাঈদীর এ কথার জবাব ঐতিহাসিক মুনতাসীর দিয়েছিলো। কবির মুক্তিযোদ্ধা ও নিহতের পরিবারের যে তথ্যচিত্র তুলে ধরেছেন তার কিছু অংশ মামুন দেখে লিখেছে, “সেখানে এক প্রৌঢ়া অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে অভিযোগ করেছে, তার স্বামীকে হত্যা করেছে সাঈদী এবং হত্যার বিচার চেয়েও সে তা পায়নি। কারণ, এখন সাঈদীর যোগাযোগ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে।”
(অসমাপ্ত)