দৈত্যাকার ঋণের বোঝায় ঝুঁকির মুখে চীনা অর্থনীতি

ডেস্ক: ঋণের বোঝা বাড়তে বাড়তে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে বিশ্বের একসময়কার দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন। চলতি বছরের জানুয়ারিতেই দেশটির ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ করেছে, তা দক্ষিণ আফ্রিকার বার্ষিক জিডিপির চেয়ে বেশি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধার নেয়ার প্রবণতা এরই মধ্যে চীনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। খবর এএফপি।

সহজ ঋণসহ অর্থনীতি উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্যে গৃহীত সরকারি নীতির সুবিধা লাভ করতে ক্রমাগত ঋণ করে চলেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ঢালাওভাবে ঋণ দেয়ার কারণে বেশকিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনাও ঘটেছে। দেশটিতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে পুরো ব্যবস্থার পতন না ঘটিয়ে মুদ্রানীতি কঠোর এবং ঋণে প্রবেশাধিকার হ্রাসের চেষ্টা করছে বেইজিং।

একাধিকবার সুদহার কর্তন ও ঋণ খাতের অনিয়ন্ত্রিত ‘ছায়া অর্থনীতি’ বাড়তে থাকায় গত বছরের শেষ নাগাদ চীনের ঋণের পরিমাণ মোট জিডিপির ২৭০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত ছায়া অর্থনীতির ফলে এরই মধ্যে ঋণে ডুবে থাকা কোম্পানিগুলো আরো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তবে সহজ ঋণ সুবিধা, নির্মাণ খাতের জোরালো সম্প্রসারণ ও অবকাঠামো খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির সুবাদে গত বছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ সম্প্রসারিত হয়েছে।

চীনের ক্রমবর্ধমান ঋণ প্রসঙ্গে গত মাসে আন্তর্জাতিক ঋণমানকারী সংস্থা ফিচের কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু ফেনেল বলেছে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হলেও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত অর্থনীতিটি বর্তমানে অতিরিক্ত ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সে আরো বলে, চীনের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি উত্সাহদায়ক হলেও তা মোটেই টেকসই নয়।

অপর ঋণমানকারী সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরসও (এসঅ্যান্ডপি) চীনের বাড়তি ঋণ নিয়ে সতর্ক করেছে। সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, ঋণচালিত প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীলতা যেকোনো সময় অর্থনীতির মুখথুবড়ে পড়ার মতো ঝুঁকি তৈরি করছে। চীনের এ ক্রমবর্ধমান ঋণের ঝুঁকি অপরিসীম।
পিপলস ব্যাংক অব চায়নার (পিবিওসি) গৃহীত মুদ্রানীতি ঋণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে একাধিকবার সুদহার হ্রাস করেছে পিবিওসি, যার ফলে ঋণ গ্রহণের ব্যয় কমেছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সহজ সুদে ঋণ গ্রহণের দিকে ছুটে চলেছে।

দেশটিতে সস্তা অর্থের প্রাচুর্য অপ্রত্যাশিত পরিণতি ডেকে এনেছে। গত বছর চীনে আবাসনসহ বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। রসুনের দাম ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, বিনিয়োগকারীরা বিটকয়েনের ওপর অর্থ ঢালতে থাকে এবং দেশটির বেশকিছু অংশে রিয়েল এস্টেটের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে।

দেখা গেছে, গত বছর বেইজিংয়ে প্রতি বর্গমিটারের গড় দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশ, নানজিংয়ে বেড়েছে ৩৮ শতাংশ এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর শেনজেনে প্রতি বর্গমিটারের গড় দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৯ শতাংশ। একই সময়ে শহরগুলোতে আবাসনের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রাহকসংকটে পড়েছে বিনিয়োগকারীরা।

অর্থনীতিবিদ ঝং পেংরং বলেছে, মুদ্রানীতি আবাসন বুদ্বুদকে আরো স্ফীত করে তুলেছে। যদি বাজার ধসে পড়ে তবে এর ঝুঁকি হবে অপরিসীম। যদিও সম্প্রতি দেশটির ডজনখানেক পৌরসভা অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়নীতি কঠোর করেছে, তা সত্ত্বেও গত মাসে গৃহীত ব্যাংক ঋণের এক-তৃতীয়াংশই ছিল আবাসন ঋণ।

এদিকে অনিয়ন্ত্রিত ছায়া অর্থনীতি নিয়ে এরই মধ্যে দুশ্চিন্তায় রয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ। পিবিওসির পরিসংখ্যান অনুসারে, গত মাসে চীনের সামাজিক অর্থায়নের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার (৩ দশমিক ৭৪০ ট্রিলিয়ন ইউয়ান)। এই অনিয়ন্ত্রিত স্কিমগুলোর মধ্যে রয়েছে কোম্পানি থেকে কোম্পানিতে ঋণ, গত বছর যার পরিমাণ ২০ শতাংশ বেড়ে ১ দশমিক ৯২ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে বলে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সাধারণত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাগুলোকে ঋণ দিতে অনিচ্ছুক হয়। যার ফলে এসব ব্যবসায়ী তারল্যের প্রয়োজনে ছায়া অর্থনীতিতে ঢুকতে বাধ্য হয়। সুদহার বাড়লেও এ ধরনের ঋণের চাহিদায় এর তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। যার অর্থ এ ব্যবস্থার দ্রুত কোনো সমাধান সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা বলেছে চীন এ মুহূর্তে অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট, তা সত্ত্বেও চীনের দৈত্যাকার ঋণের বোঝা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে।

সাংহাইয়ের মিলিয়ন টনস ক্যাপিটালের অর্থনীতিবিদ ঝাং ফাইয়ু চীনা অর্থনীতিকে দ্রুতগতির ট্রেনের সঙ্গে তুলনা করেছে। তার মতে, অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর আগে অবশ্যই এর গতি মন্থর করতে হবে। নতুবা পুরো অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে।