গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো, অশান্তির হাতছানি

ডেস্ক: এমন ভোট যুক্তরাজ্য বহুদিন দেখেনি; জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ প্রশ্নে এমন দ্বিধায় আর ভুগতে হয়নি ব্রিটিশদের। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে, নাকি ২৮ জাতির এই জোটের সঙ্গে চার দশকের সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন পথে হাঁটবে- ২৩ জুন বৃহস্পতিবার ইইউ রেফারেন্ডামে সেই সিদ্ধান্ত তাদের দিতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে গণভোট; এ কারণে একে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ‘ব্রেক্সিট’।

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ব্রিটিশ, আইরিশ ও কমনওয়েলথ নাগরিকদের মধ্যে যাদের বয়স ১৮ বা তার বেশি এবং বিদেশে অবস্থানরত যুক্তরাজ্যের যেসব নাগরিকের নাম অন্তত ১৫ বছর ধরে ভোটার তালিকায় আছে- তারা এই গণভোটে অংশ নিতে পারবেন।

ঐতিহাসিক এই ভোট নিয়ে ব্রিটেন এখন অনেকটাই বিভক্ত। পক্ষ-বিপক্ষের দুই শিবিরের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর প্রচারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত আক্রমণের অভিযোগও উঠেছে।
শনিবার সানডে টাইমসে প্রকাশিত ইউগভ জরিপে দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে (ভোট রিমেইন) আছেন ৪৪ শতাংশ উত্তরদাতা। আর বিপক্ষে (ভোট লিভ) সমর্থন দিয়েছেন ৪৩ শতাংশ। সোমবার ফাইনানশিয়াল টাইমস জনমত জরিপের যে ফল দেখিয়েছে, তাতে দুই পক্ষেই ৪৪ শতাংশ উত্তরদাতার ভোট পড়েছে।

মোটামুটি ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোটার এখনও সিদ্ধান্ত নেননি- কোন দিকে যাবেন। ইউরোপের ভবিষ্যৎ হয়ত তাদের ওপরই নির্ভর করছে।
তবে বুধবার টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক জরিপে ইইউতে থাকা-না থাকার পক্ষে সমান-সমান ভোট দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ দ্বিধাবিভক্তি স্পষ্ট।
‘লিভ’ অথবা ‘রিমেইন’

ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে যারা প্রচার চালাচ্ছেন, তাদের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে অভিবাসনের বিষয়টি। আর যারা ইইউতে থাকার পক্ষে বলছেন, তাদের প্রচারের ভিত্তি হল অর্থনীতি।
‘ভোট লিভ’ এর প্রচারকরা অভিবাসীদের ব্রিটেনে আসা বন্ধ করতে চায়। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে কেউ যাতে অবাধে যুক্তরাজ্যে এসে বসবাস করতে না পারে, সে দিকেই সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন তারা। আর সেজন্য ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসা জরুরি।
অন্যদিকে ‘রিমেইন গ্রুপ’ বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এলে ৫০ কোটি মানুষের বাজার হারাবে ব্রিটেন। তাতে অর্থনীতিতে আবার ‘ধস’ নামবে, যা এক যুগেও কাটিয়ে ওঠা যাবে না।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে ভোট দিলে তা হবে ‘একটি বিরাট ভুল’ এবং তা দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে।
সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এক নিবন্ধে ক্যামেরন ব্রিটিশ নাগরিকদের সতর্ক করে বলেছেন, এই গণভোটের রায়ে যুক্তরাজ্য নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তে পারে, যেখান থেকে ফিরে আসার পথ নেই।

federalism

ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, সাবেক দুই উপ প্রধানমন্ত্রী মাইকেল হেজেলটাইন ও নিক ক্লেইগও সানডে অবজারভারে প্রকাশিক এক যৌথ চিঠিতে ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘বিভাজন নিঃসঙ্গতাকে’ প্রত্যাখ্যান করার ডাক দিয়েছেন তারা।

অন্যদিকে, ইইউ ত্যাগের পক্ষের অন্যতম নেতা কনজারভেটিভ পার্টির মাইকেল গোভ প্রধানমন্ত্রীর আশঙ্কা নাকচ করে জনগণকে বলছেন, ‘ভোট ফর হোপ’।
ব্রিটেন ‘ব্রাসেলস এর শাসন থেকে’ মুক্ত হলে অর্থনীতি আরও উন্নত হবে বলে সবাইকে ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন তিনি।

ব্রিটেনের সাম্প্রতিক রাজনীতির ইতিহাসে ২৩ জুনের গণভোটকে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ নির্বাচন বলা হচ্ছে। কিন্তু ঐতিহাসিক এই ভোটের প্রচারে কেবল বিভ্রান্তি নয়, নোংরামিরও হচ্ছে।
‘ভোট লিভ’ পক্ষের অন্যতম নেতা ইউনাইটে কিংডম ইনডিপেনডেন্স পার্টির নাইজেল ফারাজ এমন কথাও বলেছেন যে, গণভোটের রায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাইইউ ভেঙ্গে টুকরো টুকরোকার পক্ষে গেলে অভিবাসীদের মাধ্যমে ব্রিটিশ নারীদের ‘যৌন নিপীড়ন বাড়বে’।

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোট নিয়ে ব্রিটেনে এ রকম নেতিবাচক প্রচার আগে কখনো দেখা যায়নি।
অধিকাংশ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আলোচনা ও বিতর্কের মীমাংসা পার্লামেন্টেই করা সম্ভব হওয়ায় যুক্তরাজ্যে গণভোটের ঘটনা বিরল।
পুরো যুক্তরাজ্যের জনগণের অংশগ্রহণে ইতিহাসের প্রথম গণভোটটি হয় ১৯৭৫ সালে, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় কমন মার্কেটে থাকবে কি না- সেই প্রশ্নে।

এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেনের অবস্থান নিয়ে সব প্রশ্নের সমাধান ইউকে পার্লামেন্ট বা ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আলোচনার মধ্যেমেই সম্ভব হয়েছে।

ব্রিটেনজুড়ে দ্বিতীয় ও সবশেষ গণভোটটি হয় ২০১১ সালে, বিকল্প ভোটিং ব্যবস্থা নিয়ে।
১৯৭৩ সালে কনজারভেটিভ পার্টির প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ ক্ষমতায় থাকার সময় যুক্তরাজ্য তখনকার ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটিতে (ইইসি) যোগ দেয়।
ব্রিটেন ইইসিতে যাবে কি না- সে প্রশ্নে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৯৭৪ সালে লেবার পার্টি হিথের কনজারভেটিভ পার্টিকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে।

১৯৭৫ সালের ৫ জুন সেই গণভোটে ৬৭ শতাংশ ভোটার ইউরোপিয়ান কমন মার্জেটে থাকার পক্ষে রায় দেয়।
ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা- সে সিদ্ধান্ত নিতে ৪১ বছর পর আবারও গণভোটে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য।

ব্রিটেন ইউরোপীয় সিঙ্গেল কারেন্সি এলাকা অর্থাৎ ইউরোজোনে যোগ দেবে কি না- সে প্রশ্নে ১৯৯২ সালে গণভোট করার চাপ ছিল যুক্তরাজ্য সরকারের ওপর। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রে গণভোটের তেমন প্রয়োজন নেই- এমন যুক্তিতে সেবার ভোট এড়ানো সম্ভব হয়।