‘বেগম’ প্রসঙ্গে কিছু অজানা কথা

জেবুন্নাহার চৌধুরী: তৎকালীন মুসলিম সমাজে নারীজাগরণের অগ্রদূত একটি সচিত্র সাপ্তাাহিক পত্রিকা ‘বেগম’। বঙ্গাল মুলুকে নারীবাদীদের প্রথম পত্রিকা এটি। ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে নারী স্বাধীনতা ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে নারীদের ঘর থেকে বের করে আনতে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই কাজ করে আসছে পত্রিকাটি। পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলো সুফিয়া কামাল, কিন্তু চার মাস পরে সম্পদাকের দায়িত্ব গ্রহণ করে নূরজাহান। নূরজাহানের একটি পরিচয় হচ্ছে, তিনি (বামপন্থী) কুনুজ্জামান দাদা ভাইয়ের স্ত্রী। নূরজাহান বেগম (জুন ৪, ১৯২৫ – ২৩ মে, ২০১৬) বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত এবং সাহিত্যিক। তিনি সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কন্যা। ভারত উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা “বেগম” পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে এর সম্পাদনার কাজে জড়িত এবং ছয় দশক ধরে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর ডাক নাম ছিল নূরী।

এবার সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ সম্পর্কে কিছু কথা:

বেগম-এর প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল-
“মুসলিম সমাজ আজ এক কঠোর দায়িত্ব গ্রহণের সম্মুখীন। অর্জিত স্বাধীনতার সম্মান ও গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে কেবল পুরুষেরই নয়, মুসলিম নারীকেও এগিয়ে আসতে হবে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে।
তার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ নারী-সমাজকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে তারা সেই স্বাধীন-সার্বভৌম আদর্শ-রাষ্ট্রের-সত্যিকার দাবিদার হতে পারে সগৌরবে।
এর জন্য চাই আমাদের মানসিক প্রয়াস- আশা-আকাঙ্খার ব্যাপ্তি আর জীবন সম্বন্ধে এক স্থির ধারণা। কিন্তু জীবনের প্রতি পরিপূর্ণ দৃষ্টিপাত সম্ভব কেবল সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যস্থতায়। অথচ সাহিত্য শিল্পচর্চায় আমরা (মুসলমান নারী) এখনও উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকারে সক্ষম হইনি।

এর কারণ নানাবিধ- তবে মহিলাদের জন্য সাময়িক পত্রিকার সম্পূর্ণ অভাব এর প্রধানতম কারণ।
সুধী ব্যক্তিরা বলেন, জাতি গঠনের দায়িত্ব প্রধানত নারী-সমাজের হাতে- কথাটা অনস্বীকার্য নয়। এবং এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হলে পৃথিবীর কোনোদিক থেকেই চোখ ফিরিয়ে থাকলে আমাদের চলবে না, এ কথাও মানতে হবে। শিল্প, বিজ্ঞান থেকে আরম্ভ করে গৃহকার্য ও সন্তান পালনে- সর্বক্ষেত্রে আমরা সত্যিকার নারীরূপে গড়ে উঠতে চাই। আল্লাহর রহমতে ‘বেগম’ সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা রূপে প্রকাশিত হলো।”

১৯৪৭ সাল সময়টিতে এ উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে ছিলো খোদাভীরুতা, ধর্ম-কর্ম পালনে অধিক মনযোগী। নারীরা ছিলো চরম পর্দাশীল, শালীন ও সম্ভ্রান্ত। সূতরাং এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থা অর্জন করতে হলে ধর্মের কথা বলেই আস্থা অর্জন করতে হবে, বিকল্প কোন পথ নেই। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এতো জনপ্রিয়তার রহস্যও এটাই। তিনি মানুষের ধর্মীয় সেন্টমেন্টকে গুরুত্ব দিতেন। একইভাবে বেগম পত্রিকার যাত্রাও শুরু হয় মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে স্পর্শ করেই।

বেগম-এর পরবর্তী রূপ:
২০১১ সালে বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান দৈনিক প্রথম আলোর কাছে এক সাক্ষাৎকারে বলে-“নারীকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। সে জন্য সমাজের কিছু ভূমিকা রয়েছে। সমাজ থেকে কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা একদম দূর করতে হবে। তবেই পুরোপুরি নারীমুক্তি হবে।”
ডেইলি স্টারে নুরজাহান আরো বলে- “আমি নিজেকে একজন ফেমিনিস্ট (নারীবাদী) মনে করি, আমরা আমাদের সমাজ পরিবর্তন করতে চাই”।

উল্লেখ্য, ৫০ এর দশকে একজন মুসলিম নারী পর্দা ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে পারতেন না, সেখানে নুূরজাহান ও তার বাবা নাসিরুদ্দিন নারীদের ছবি তুলে পত্রিকায় প্রকাশ করে দিতো। বিষয়টি এখন শুনতে স্বাভাবিক লাগলেও ঐ সময় স্বাভাবিক ছিলো না, কারণ তখন নাটক-যাত্রাপালায় পর্যন্ত পুরুষরা নারীদের চরিত্রে অভিনয় করতো। বলা যায়, বর্তমানে নারী স্বাধীনতার নামে নারীদের অশালীন ও বেপরোয়া চলাফেরার অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলো নূরজাহান।

এখানে লক্ষণীয়-
নূরজাহানরা বেগম পত্রিকা শুরু করেছিলো মুসলিম নারীদের অগ্রযাত্রার কথা বলে, তাদের ধোকা দিয়ে। প্রথম প্রথম ধর্মের কথা দিয়েই তারা নারীদের মধ্যে ঢুকতো। যেমন ধর্ম সম্পর্কে মহিলাদের জ্ঞান লাভের জন্য ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘বেগম বিশ্বনবী সংখ্যা’। এ সংখ্যায় ২৪টি প্রবন্ধ, ৪টি কবিতা, ২টি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। কিন্তু শেষে এসে সেই নূরজাহানই বলছে- তার লক্ষ্য ছিলো ফেমিনিজম, নারীকে ঘর থেকে বের করা, নারীদের ধর্মভিরুতা রোধ করা। আসলে নাস্তিক গুরু বদরুদ্দিন ওমর যেমন ‘লেখক শিবির’ নামক ক্লাব খুলে বড় বড় নাস্তিক পয়দা করেছে, ঠিক তেমনটি নূরজাহানও ‘বেগম’ পত্রিকা খুলে ফেমিনিস্ট জন্ম দিয়েছে।

মূলত এসব পত্রিকার পেছনে ইসলাম বিদ্বেষী ইহুদীদের যোগসাজস বিদ্যমান। এর প্রমাণও পাওয়া যায়, ১৯৫৪ সালে মার্কিন ইহুদী ফেমিনিস্ট আইদা আলসেথ ঢাকায় বেগম পত্রিকা অফিস পরিদর্শন করে। তার দিক নির্দেশনায় ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বেগম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, সেক্রেটারি হন নূরজাহান বেগম এবং বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা।

বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম ২৩ মে (২০১৬) তারিখ ৯১ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যুর সংবাদ  ও তার জীবন নিয়ে আর্টিকেল গুরুত্বের সাথে প্রকাশ হয় বিবিসি, ডেইলি স্টার, প্রথম আলোর মতো বিভিন্ন বামপন্থী গণমাধ্যমগুলোতে।

লেখিকা: কলামিস্ট ও গবেষক।