ধর্মান্ধ সন্ত্রাসবাদ উত্থানের ইতিকথা

নিউজ নাইন২৪, ডেস্ক: দেশে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটে ২০০৪ সালে। অভয়ারণ্য হিসেবে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীগোষ্ঠী বেছে নেয় চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি জনপদকে। গড়ে তোলে ঘাঁটি। জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এ এলাকায় গড়ে তোলে ৭টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বিদেশী গেরিলাদের সহায়তায় ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা যুদ্ধের নানা কৌশল রপ্ত করে। সেই সঙ্গে আফগানফেরত যোদ্ধা মুফতে আবদুল হান্নান দায়িত্ব নেয় ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণের। ছাত্র শিবিরের সাবেক তরুণ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে তথাকথিত বাংলাভাই ওরফে বাংলাসন্ত্রাসী গ্রহণ করে অপারেশন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব। সমুদ্রপথে অস্ত্র, বোমা, গ্রেনেড সংগ্রহ করা, বিদেশী প্রশিক্ষিত কমান্ডারদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেয়ার করাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলকে বেছে নেয় তারা। খাগড়াছড়ির পানছড়ি, চেংড়াছড়ি, বান্দরবানের ফাইতং, চকরিয়া, রাঙ্গামাটির লংগদু, ভূষণছড়া, মহালছড়ি ও বরকল এলাকায় গড়ে উঠে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি। সুযোগ বুঝে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা পাহাড় থেকে নেমে আসে সমতলে।
২০০৪ সালের মার্চ মাসে সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাসন্ত্রাসীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীতে চলে যায় একটি দল। সেখানেই শুরু হয় অপারেশনাল কর্মকান্ড।

ধর্মান্ধ সন্ত্রাসবাদের বীজ এর অনেক আগে থেকে বপন করা হলেও সশস্ত্ররূপে তারা আত্মপ্রকাশ করে ২০০৪ সালের মাঝামাঝি। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের অংশীদার বিশেষ গোষ্ঠীর নেপথ্য ইশারায় স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ২০০৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে রাজশাহী, বাগমারা, রানীনগর, আত্রাইয়ে শুরু হয় তা-ব। কিছুদিন পর ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা আবার ফিরে যায় চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। সেখানে চলে বোমা ও ভারিঅস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বোমা হামলায় প্রকম্পিত হয়ে উঠে গোটা দেশ। ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী আছে, ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী নেইÑ তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের এই টালবাহানায় ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। মেতে উঠে হত্যাযজ্ঞে। এসব কর্মকা-ের খলনায়কের নাম মালানা আব্দুর রহমান ওরফে আব্দুশ শয়তান।

ধর্মান্ধ ওহাবী সন্ত্রাসবাদের উত্থানের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৮০ সালে ওহাবী মালানা আব্দুর রহমান ওরফে আব্দুশ শয়তান ছিলো ওহাবী ফেরকাপন্থী গ্রুপ তথাকথিত জমিয়তে আহলে হাদিসের সভাপতি। ১৯৮১ সালে সে ওহাবীদের নিয়ন্ত্রিত মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সউদী সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে যায়। ১৯৮৩ সালে দেশে ফিরে রাজশাহীতে তথাকথিত আহলে হাদিসের সাংগঠনিক বৈঠকে ইসলামের নামে সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদের ঘোষণা দেয়।
ওই সময় মতবিরোধ হলে মালানা আব্দুশ শয়তান প্রতিবাদ করে সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসে। তথাকথিত আহলে হাদিসের একটি গ্রুপের নিয়ন্ত্রক হয় মালানা আব্দুশ শয়তান। এসময় ছদ্মনামে বই লেখা শুরু করে সে। তার ছদ্মনাম ছিল আবদুল হামিদ। এই নামে প্রথম বইটি ছিল ‘দ্বীন কায়েমের সঠিক আক্বীদা।’ বইটি ৫০ হাজার কপি ছাপিয়ে দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ওহাবী বাতিল ফিরকাপন্থী গ্রুপ তথাকথিত আহলে হাদিস আন্দোলনের কার্যক্রম অনেক আগে থেকে চালু রয়েছে। মালানা আব্দুশ শয়তান লক্ষ্য ভিত্তিক তথাকথিত আহলে হাদিস আন্দোলনের দ্বারস্থ হয় আর্থিক সহায়তার জন্য।
১৯৯২ সালে মইত্যা রাজাকার নিজামীর সহায়তায় মালানা আব্দুশ শয়তান সউদী আরবে কুয়েত দূতাবাসে চাকরি করতে চলে যায়। সউদী আরবে চাকরির পাশাপাশি সে ‘ইসলামিক উন্নয়ন’ নামধারী যেসব সংগঠন কাজ করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার সঙ্গে পাকিস্তানের জামাতের নেতা কাজী হোসাইন আহমদ, সাইফুল ইসলাম বান্না, হামাস নেতা ফাতহী শাকার্কী, হামাস নেতা শেখ আহমদ ইয়াসিনের সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে উঠে। ১৯৯৩ সালে সে দেশে ফিরে তথাকথিত ‘জমিয়তে আহলে হাদিস আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামক ওহাবীবাদী সংগঠন তৈরিকরে। সে এ সংগঠনের পেছনে বিদেশে থেকে আনা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে থাকে।

এক পর্যায়ে জামাত থেকে তথাকথিত আহলে হাদিস আন্দোলনে অনেক নেতাকর্মীকে দলে নেয়। তাদের প্রধান যুক্তি সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া দেশে ইসলাম কায়িম করা সম্ভব নয়। ১৯৯৮ সালে মালানা আব্দুশ শয়তান গঠন করে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের ধর্মান্ধ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। এই সংগঠনের সে আমীর নিযুক্ত হয়।
উল্লেখ্য যে, ১৮৫০ সালের দিকে উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী জামা’আতুল মুজাহিদীন নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়েছিল। কিন্তু কালের চক্রে ১৯২৫ সালের দিকে এসে এ সংগঠনটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়।

১৯৯৮ সালের পর থেকে জামা’আতুল মুজাহিদীন সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থান, রাজনৈতিক ব্যক্তি, সংস্থাকে ইসলামবিরোধী চিহ্নিত করে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইসলামের নামে বিদেশে থেকে আনা কোটি কোটি টাকা সে সংগঠনের পেছনে ব্যয় করতে থাকে। ২০০২ সালে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের কার্যক্রম শুরু হয়। ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে মাদরাসা থেকে সংগ্রহ করা হয় সহজ-সরল ছাত্রদের। তাদের সংগঠিত করে গড়ে তোলা হয় বাহিনী। ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীগোষ্ঠী টার্গেট করে চরমপন্থী নির্যাতিত এলাকা।

রাজশাহীর বাগমারা, মোহনপুর, দুর্গাপুর, নওগাঁর রানীনগর, আত্রাই এবং নাটোরের নলডাঙ্গা চরমপন্থী এলাকা হিসেবে খ্যাত। এই এলাকায় স্থানীয় পরিষদ বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ চরমপন্থীদের সহযোগিতা ছাড়া অসম্ভব ছিল। তাই যারা স্থানীয় পরিষদ বা জাতীয় সংসদে নির্বাচনে জয়লাভ করে তারা বেশিরভাগই দলমত নির্বিশেষে চরমপন্থীর শেল্টার নিয়ে চলে। একপর্যায়ে স্থানীয় রাজনীতিকরা চরমপন্থী দমন করতে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের বেছে নেয়। মদদ যোগায় তাদের। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিষয়টি ছিল অনেকটা সাপ নিয়ে খেলা করার মতোই। এক সময়ের বাগমারায় বেড়ে উঠা ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।

ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের উত্থান ও অপতৎপরতা প্রসারের নেপথ্যে চারদলীয় জামাত-জোট সরকারের সাবেক একাধিক মন্ত্রী সাংসদের বড় ধরনের ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী নেতাদের মদদ দিত। মাওলানা আব্দুশ শয়তান ও বাংলা সন্ত্রাসী তাদের নেপথ্য মদদদাতাদের ব্যাপারে গোয়েন্দাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলে জানা গেছে। এই দুই শীর্ষ ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী নেতা অনেক ‘না বলা কথা’ সাংবাদিকদের কাছে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সে সুযোগ পায়নি।