প্রাণীর ভাস্কর্য বিষয়ে দ্বীন ইসলামে বিধান কী?
ডেস্ক: আলেম শ্রেণীর মধ্যে কেউ কেউ কিছু ইসলামি কিতাবের সূত্র দিয়ে মূর্তিকে জায়িয প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। সেখানে তাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে, যে মূর্তিকে পূজা, আরাধনা, ইবাদত করা হয়, যেটা মানুষকে মুশরিক বানায়; সেটা নিষেধ। কিন্তু যে মূর্তিকে আরাধনা ইবাদত করা হয় না বরং যে মূর্তি সৌন্দর্য বাড়ায়, সুসজ্জিত করে সেটা নিষেধ নয়।
অতএব, কতিপয় আলেমদের এ ধরণের যুক্তি কতটুকু ইসলামসম্মত? দলীলসহ জাওয়াব দিয়ে বিভ্রান্তি নিরসন করবেন।
জাওয়াব:
আসলে কোন শর্তেই প্রাণীর আকৃতি/অবয়ব সৃষ্টি করা দ্বীন ইসলামে জায়েজ নেই বরং কঠোরভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সেটাকে ভাষ্কর্য, শিল্প, স্থাপনা, নকশা যাই হোক না কেন এবং যে নিয়তেই হোক না কেন, তা সুষ্পষ্ট হারাম। তবে যেমস্ত ভাস্কর্য প্রাণীর নয়, প্রাণীর কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গেরও নয় এবং আকার ইঙ্গিতেও প্রাণীর বোঝায় না এককথায় জড় বস্তু হলে এমন ভাস্কর্য তৈরি করতে নিষেধ নেই। যেমন- বই, কলম, অস্ত্র, গাড়ি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি জড় বস্তু হলে এগুলোর ভাস্কর্য তৈরি করা যাবে।
আল কুরআনের বিভিন্ন পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা এটি সুষ্পষ্ট হারাম হয় যে, প্রাণীর অনুরুপ আকৃতি/অবয়ব/ছবি এসব সৃষ্টি করা কঠিন ভাবে আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করে দিয়েছেন।
বিশিষ্ট ছাহাবা হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
قال الله تعالى ومن أظلم ممن ذهب يخلق كخلقى فليخلقوا ذرة، او ليخلقوا حبة، أو ليخلقوا شعيرة. (أخرجاه)
অর্থঃ “খ্বলিক মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন, ‘তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যে ব্যক্তি আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করতে চায়। তাদের শক্তি থাকলে তারা একটা অনু সৃষ্টি করুক অথবা একটি খাদ্যের দানা সৃষ্টি করুক অথবা একটি গমের দানা তৈরী করুক।” (বুখারি ও মুসলিম শরীফ)
ইবনে আববাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন-
كل مصـور فى النـار يجعل له بكل صورها نفـس يعذب بـها فى جهنم. (رواه مسلم)
অর্থঃ “প্রত্যেক চিত্র অঙ্কনকারীই জাহান্নামী। চিত্রকর যতটি [প্রাণীর] চিত্র এঁকেছে ততটি প্রাণ তাকে দেয়া হবে। এর মাধ্যমে তাকে জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে।” (মুসলিম শরীফ)
হযরত ইবনে আববাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে-
من صور صورة فى الدنيا كلف أن ينفع فيها الروح وليس ينافخ. (رواه البخارى ومسلم)
অর্থঃ “যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন [প্রাণীর] চিত্র অঙ্কন করবে, কিয়ামতের দিন তাকে ঐ চিত্রে আত্মা দেয়ার জন্য বাধ্য করা হবে। অথচ সে আত্মা দিতে সক্ষম হবে না।” (বুখারি ও মুসলিম)
পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত আছে, “সে ঘরে (রহমতের) ফিরিশতা প্রবেশ করেন না, যে ঘরে কুকুর থাকে এবং ছবি-মূর্তি থাকে। (বুখারি ও মুসলিম )
আবুল হাইয়াজ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, সাইয়্যিদুনা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি কি তোমাকে এমন কাজে পাঠাবোনা, যে কাজে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন? সে কাজটি হচ্ছে, ‘তুমি কোন চিত্রকে ধ্বংস না করে ছাড়বে না।”
নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেখানেই প্রাণীর আকৃতির কোন ছবি/মুর্তি/ভাষ্কর্য দেখেছেন হয় নিজ হাতে ধ্বংস করেছেন নতুবা কাউকে সরাসারি আদেশ মুবারক করেছেন ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। এখানে নিয়তের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। নিয়ত ভালো হলে মূর্তি-ভাস্কর্য করা যাবে এমন কোন বর্ণনা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ ও ইজমা কিয়াসের কোন কিতাবে নেই।
এমনকি সেটা হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম এবং উনার সম্মানিতা আম্মা হযরত মারিয়াম আলাইহাস সালাম উনাদের প্রতিকৃতিও অক্ষুণ্য ছিলোনা, থাকার কেনো প্রমাণ নেই। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম ও উনার সম্মানিতা আম্মা আলাইহাস সালাম উনাদের ছবি নষ্ট করতে নিষেধ করেন, তা কেউ বর্ণনা করেননি। কেউ বলে থাকলে এটি সম্পূর্ণই বানোয়াট।
যেমন ইবনে ইসহাক রহমতুল্লাহি আলাইহি জীবনী গ্রন্থের দুই ধারক হযরত ইমাম তাবারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ও হযরত ইবনে হিশাম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা কেউই এ বর্ণনাটি উল্লেখ করেননি। এ দুটো জীবনী গ্রন্থ ছাড়া অন্য কোনো জীবনী গ্রন্থেও এর উল্লেখ নেই।
উল্লেখ্য, হিজরী ৮ম সনে পবিত্র মক্কা শরীফ বিজয়ের দিন স্বয়ং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম উনাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সম্মানিত কা’বা শরীফ উনার মধ্যে অবস্থিত সমস্ত মূর্তি, ভাস্কর্য, ছবি ধ্বংস করে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করেছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, মূর্তি, ভাস্কর্য, ছবি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার পরেই অর্থাৎ হিজরী ৯ম সনে পবিত্র হজ্জ ফরয করা হয়। সুবহানাল্লাহ!
আরো উল্লেখ্য, অতীতের কোন বিষয় সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মুখালিফ বা বিরোধী হলে তা মুসলমানদের জন্য গ্রহণ করা বা অনুসরণ করা জায়িয নেই। যেমন- আবুল বাশার হযরত আদম ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার যামানা থেকে শুরু করে হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনার যামানা পর্যন্ত আপন ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ জায়িয ছিল। তাই বলে কি এখন আপন ভাই-বোন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়িয হবে? কখনোই নয়। কেউ যদি জায়িয মনে করে, সে কি মুসলমান থাকবে? বরং সে কাট্টা কাফির ও চির জাহান্নামী হবে। তদ্রুপ হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম উনার যামানায় মূর্তি, ভাস্কর্য থাকার দলীল সম্মানিত দ্বীন ইসলাম বা সম্মানিত মুসলমানদের জন্য কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
যেমন এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক উনার সম্মানিত কিতাব পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-
هُوَ الَّذِىْ أَرْسَلَ رَسُوْلَه بِالْهُدٰى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَه عَلَى الدِّيْنِ كُلِّه ۚ وَكَفٰى بِاللّٰـهِ شَهِيْدًا
অর্থ: তিনি ঐ মহান আল্লাহ পাক যিনি উনার শ্রেষ্ঠতম রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে হিদায়েত ও সত্য দ্বীন অর্থাৎ সম্মানিত দ্বীন ইসলাম তথা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ সহকারে প্রেরণ করেছেন (পিছনের ওহী মুবারক দ্বারা নাযিলকৃত এবং অতীতে, বর্তমানে ও ভবিষ্যতে মানবরচিত সমস্ত দ্বীন-ধর্ম-মতবাদের উপর প্রাধান্য দিয়ে তথা বাতিল ঘোষণা করে। এ ব্যাপারে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে মহান আল্লাহ পাক তিনিই যথেষ্ট। (পবিত্র সূরা ফাতহ শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
মূলত প্রাণীর আকৃতি (মূর্তি/ভাস্কর্য/ছবি ইত্যাদি) তৈরী হারাম ও নাজায়েজ এ বিষয়ে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ থেকে সহস্রাধিক দলিল আছে যা মাসিক আল বাইয়্যিনাত নামক একটি ইসলামী মাসিক পত্রিকায় ফতোয়া আকারে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছে।
– গবেষণা কেন্দ্র: মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ মাদরাসা