আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ ধারণার প্রবর্তক বাংলাদেশের ফজলুর রহমান

নিউজ নাইন২৪ডটকম, ডেস্ক: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বিশ্বব্যাপী মোট ১৫০টি বহুতল ভবনের মধ্যে ১৪৭টির ঠিকানাই ছিল আমেরিকা। শ্রমশিল্পকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারত! এক্ষেত্রে স্থাপত্যশৈলীকেও আমলে নেয়া হয়নি। মূলত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্যই আকাশছোঁয়া ভবন নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়ে দেশটি। আর ঠিক এমন একটি সময়ে আমেরিকানরা খুঁজে নেন ফজলুর রহমান খানকে; আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ ধারণার প্রবর্তক: বাংলাদেশে জন্ম নেয়া এক স্থপতি।

শুধু নতুন ধরনের নকশাকে আর নির্মাণরীতিকে পরিচিত করিয়ে দেয়া নয়, বিংশ শতকের নির্মাণ নকশাকেও ভীষণ রকম প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এ ব্যক্তিত্ব। এফআর খানকে তাই বলা হয় টাম্বলার ডিজাইনের জনক (tumbler designer)। আমেরিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভবন উইলস টাওয়ার আর ১ হাজার ১২৭ ফুট উঁচু জন হ্যানকক সেন্টারের নকশাকার তিনি।

প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান
স্থাপতি ফজলুর রহমান খান

১৯২৯ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকায় জন্ম নেন ফজলুর রহমান খান। বাবা গণিতের শিক্ষক ছিলেন, পাঠ্যবই লিখেছেন, কাজ করেছেন এ অঞ্চলের জনশিক্ষা পরিচালক হিসেবে। অবসর-পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাবাই মূলত ফজলুর রহমান খানের মনে প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোকে ঘিরে আগ্রহের বীজটি বুনে দেন, সন্তানকে উৎসাহিত করেন কলকাতায় অবস্থিত বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) থেকে ডিগ্রি নিতে। বাধ্য ছেলেটি তা করেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক পাঠক্রম সম্পন্ন করে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর স্নাতক ডিগ্রি নেন।

মেধাবী ছাত্রটিকে এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকারের বৃত্তির পাশাপাশি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে তিনি আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। মাত্র তিন বছরে এ প্রতিষ্ঠান থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স; দুটি বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পাশাপাশি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের বিরল কাজটি সম্পন্ন করেন ফজলুর রহমান খান। পিএইচডিতে তার থিসিসের বিষয় ছিল ‘অ্যানালিটিক্যাল স্ট্যাডি অব রিলেশনস অ্যামং ভেরিয়াস ডিজাইন ক্রাইটেরিয়া ফর রেকট্যাঙ্গুলার প্রেসট্রেসড কংক্রিট বিমস।’

পড়াশোনার পাঠ শেষ করে কিছুদিনের জন্য ঢাকায় এলেও আবার আমেরিকায় ফিরে যান, তবে এবার সেখানে গমনের উদ্দেশ্যটি ভিন্ন, পৃথিবীতে হাতেগোনা যে কয়টি স্থাপত্য ও প্রযুক্তি ফার্ম রয়েছে স্কিডমোর ওয়িংস অ্যান্ড মেরিলের (এসওএম) মধ্যে অন্যতম, ১৯৫৫ সালে এ প্রতিষ্ঠানটির আমেরিকা অফিসে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদানের আহ্বান জানানো হয় তাকে।

আমেরিকান লেখক অ্যালেক্স উয়েনবার্গ তার একটি আর্টিকেলে এ প্রকৌশলী সম্পর্কে বলেছে, “ফজলুর রহমান খান এমন একটি দেশ থেকে এসেছেন, যেখানে সে সময় বহুতল ভবন নির্মাণের তেমন কোনো ইতিহাস ছিল না। তিনি কেবল নিজের পথে হেঁটেছেন আর এভাবেই তিনি স্থাপত্য ধারণার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হন। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের পাশাপাশি তিনি আমেরিকানদের জন্য এমন সব স্থাপনা নির্মাণ করেছেন, যা নিয়ে তারা গর্ব করতে পারে।”

fazlur rahman khan - Tumblrটিউব স্ট্রাকচারাল সিস্টেম: আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ নকশার অন্যতম অন্তরায় কেবল এর কাঠামোগত ওজন নয়, এর পারিপার্শ্বিক ভার, যেমন: বাতাস, ভূমিকম্প— যা কিনা ভবনটির কাঠামোর ওপর বাড়তি চাপ প্রয়োগের সামর্থ্য রাখে। তীব্র বাতাস যখন উঁচু কোনো ভবনের বিপরীতে প্রবাহিত হয়, নিয়মমাফিক ভবনে তা আঘাত হানে। আর নির্মাণ ও নকশা দিয়ে এমন সংকট উত্তরণের জন্য ফজলুর রহমান খান প্রবর্তন করেন টিউব স্ট্রাকচারিয়াল পদ্ধতি; এর মধ্যে রয়েছে ফ্রেমড টিউব, ট্রাসড টিউব, বানডেল টিউব।

টিউব স্ট্রাকচার পদ্ধতিতে কংক্রিট আর ইস্পাত ব্যবহার করে উঁচু ভবন নির্মাণের সীমাবদ্ধতা জয় করার সঙ্গে কাজকে সহজ করেন তিনি। তার উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিটি অনায়াসে প্রয়োগ করা যায় অফিস, অ্যাপার্টমেন্ট আর বহুমাত্রিক কাজে ব্যবহারিত ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে। ষাটের দশকে ফজলুর রহমান খানের নতুন এ নির্মাণ পদ্ধতিটি গোড়াপত্তন করে ৪০ তলা উচ্চতাসম্পন্ন ভবন নির্মাণ ধারাকে।

জন হ্যানকক সেন্টার এবং ট্রাসড টিউব:

জন হ্যানকক সেন্টার নির্মাণের প্রাথমিক ধারণাটা আসে ঠিকাদার জেরি ওলম্যানের মাধ্যমে। একটি প্লটে ছোট দুটি আলাদা বিল্ডিং— এমন ছিল শর্ত। একই ভবনের বড় পরিসরে অফিস আর অল্প পরিসরে অ্যাপার্টমেন্ট— এসওএম ফার্মের স্থাপত্য নকশাকারদের এমন কথা শুনে প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়ার জোগাড়। তবে শেষে, স্থপতিদের দলটি নকশায় দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আর উচ্চতার মধ্যে সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান দেখলেন এ ভবনের নির্মাণ প্রক্রিয়াটি তাকে ট্রাসডি টিউব ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে। এ পদ্ধতিটি তিনি যৌথভাবে উদ্ভাবন করেছিলেন মিকিও সাসাকির সহযোগিতায়, যিনি ছিলেন ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির শিক্ষার্থী।

অন্যান্য কাজ:

কেবল আকাশচুম্বী নয়, ভিন্ন ধরনের নকশার নির্মাণ প্রকৌশলী হয়েও কাজ করেছে খান। যার মধ্যে রয়েছে সৌদি আরবের কিং আবদুলআজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, কিং আবদুলআজিজ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকার এয়ার ফোর্স একাডেমি। কিং আবদুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের প্রকৌশলী হিসেবে তাকে সম্মানিত করা হয় আগা খান পুরস্কারে।

kingabdulairport
কিং আবদুলআজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট

 

কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন:

সত্তরের দশকের কথা, প্রকৌশলীরা সবে কম্পিউটার ব্যবহার করে ভবনের স্ট্রাকচার বিশ্লেষণের কাজ শুরু করেছেন। এসওএম ছিল নির্মাণ নকশায় দারুণ সব নতুন পদ্ধতি আর প্রযুক্তির উন্নয়ন কেন্দ্র, যার নেপথ্যের মানুষটিও ছিলেন ফজলুর রহমান খান। কম্পিউটারের মাধ্যমে নকশা করা ও তা পরিমার্জন ও বিশ্লেষণের জন্য তিনি প্রবর্তন করেন ‘কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন’ (ক্যাড)। এ সফটওয়্যারের সাহায্যে স্থপতিদের নকশা করার প্রক্রিয়াটি সহজ হওয়ার পাশাপাশি স্থাপত্য নকশার মান উন্নয়নে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

এই মহান প্রকৌশলী-স্থপতি উনিশ-বিশ শতকে জাহাজ থেকে লাফিয়ে নামা সেসব বাঙালি মুসলমানের একজন নন ঠিক, কিন্তু এফআর খানের আগে যারা শূন্য হাতে আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছিলেন, অন্য অনেক অভিবাসীর সঙ্গে মিলে আজকের উন্নত আমেরিকা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন, এফআর খান তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম। আমেরিকা আবিষ্কারে-নির্মাণে ভূমিকা রাখা সেসব অজানা অনেকে মহৎ প্রাণের সঙ্গে তাই এই ক্ষণজন্মা পুরুষকেও সশ্রদ্ধ স্মরণ।