অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির হাতছানি সমুদ্র

নিউজ ডেস্ক:সমুদ্র অর্থনীতিতে (ব্লু ইকোনমি) বিনিয়োগের নতুন দিগন্তে বাংলাদেশ। এ বছরের মধ্যেই সমুদ্র অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে চায় সরকার। এই লক্ষ্য পূরণে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশের জলসীমায় সাগরের নিচে নতুন অর্থনীতি। সাগরের তলদেশ ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৫ শতাংশ অর্জিত হবে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে।

গভীর সমুদ্রের বিশাল অংশ বাংলাদেশের জলসীমায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর পরিমাণ দেশের স্থলভাগের প্রায় ৮১ শতাংশ। এখানে রয়েছে ছোট বড় মিলিয়ে ৭৫টির মতো দ্বীপ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এগুলোকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হক বলেন, ‘সমুদ্রের পানির নিচে লুকিয়ে থাকা সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে। সমুদ্র অর্থনীতিতে বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের সম্পদশালী অনেক দেশ বাংলাদেশের নীল সমুদ্র অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী।’ বঙ্গোপসাগরের অফুরান সম্পদ কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে আহরণ সম্ভব হলে ১০ বছরের মাথায় বাংলাদেশের অর্থনীতি অভাবনীয় উচ্চতায় পৌঁছবে বলে তার ধারণা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সময়ে তৈরি করা বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ সীমানার অন্তত ১৩টি স্থানে রয়েছে সোনার চেয়েও মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম। যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইট। অগভীরে জমে আছে ‘ক্লে’, যা দিয়ে তৈরি হয় সিমেন্ট। ধারণা করা হচ্ছে, এর পরিমাণ হিমালয়কেও হার মানাবে। এই ক্লে উত্তোলন সম্ভব হলে বাংলাদেশের সিমেন্ট কারখানাগুলো আরও শক্তিশালী হবে। এ ছাড়াও তেল-গ্যাসের সন্ধানও মিলেছে সমুদ্রের তলদেশে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে ‘সমুদ্র বিজয়’ এই সম্ভাবনাকে আরও প্রসারিত করেছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিশ্বের ৩৫ কোটি মানুষের জীবিকা সরাসরি সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনের শতকরা ২০ ভাগ জোগান আসে সমুদ্র থেকে। বিশ্বের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৬ ভাগের অবদান বঙ্গোপসাগরের। সংশ্লিষ্টদের আশা, সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ উৎপাদন আরও অনেক গুণে বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ আসে সমুদ্রে মাছ আহরণ, সামুদ্রিক খাদ্য ও বাণিজ্যিকভাবে সমুদ্র পরিবহন থেকে। প্রায় তিন কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, কেবল সমুদ্র অর্থনীতির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে যথেষ্ট আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। সমুদ্র ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সাগর থেকে পাওয়া বায়ু, তরঙ্গ-ঢেউ, জোয়ার-ভাটা, জৈব-তাপীয় পরিবর্তন এবং লবণাক্তের মাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক পরিমাণে নবায়নযোগ্য শক্তির জোগান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিবছর পৃথিবীতে সমুদ্রবর্তী বায়ু ব্যবহারের সক্ষমতা ৪০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশকে যদি চীন বা তার মতো বৃহৎ অর্থনীতি থেকে উপকৃত হতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর আধুনিকায়ন করে এগুলোকে গমনপথ হিসেবে ব্যবহারের কোনও বিকল্প নেই।
জানতে চাইলে পরমাণু শক্তি কমিশনের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেতারা ইয়াসমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাগরের নিচে শুধু গ্যাসই নয়, বঙ্গোপসাগরে ভারি খনিজসম্পদ রয়েছে। ভারি খনিজের মধ্যে রয়েছে ইলমেনাইট, টাইটেনিয়াম অক্সাইড, রুটাইল, জিরকন, গার্নেট, কোবাল্টসহ অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। এসব সম্পদ থেকে বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।’
মৎস্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের তলদেশে তেল, গ্যাস বা খনিজসম্পদই শুধু নয়, বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রের ন্যায্য অধিকার পাওয়ায় মৎস্য আহরণের বিপুল সম্ভাবনাও দেখছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে, এ অঞ্চলের টুনা মাছ সারাবিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। সুস্বাদু ও দামী এই মাছ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের হোটেলগুলোতে আমদানি করা হয়ে থাকে। টুনা মাছের বিচরণ গভীর সমুদ্রে। বাংলাদেশের ফিশিং ট্রলার এখন গভীর সমুদ্রে টুনাসহ অন্যান্য মাছ ধরার সুযোগ পাচ্ছে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ মৎস্য আহরণের পাশাপাশি সমুদ্রের তীরবর্তী পর্যটনকেন্দ্রের মাধ্যমেও অর্থনৈতিক বিপ্লবের কথা ভাবছে বংলাদেশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার পর্যটন শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই আন্তরিক। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে দেশের বিভিন্ন স্থানের ঐতিহাসিক নিদর্শনের স্থানগুলোসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্র স্থানগুলোকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা চলমান রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এসব উদ্যোগের অংশ হিসেবে সমুদ্রের ভেতরে জেগে ওঠা সম্ভবানাময় চরগুলোকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করছে। এসব পরিকল্পনা বা উদ্যোগ সফল হলে এ খাত থেকে আসা আয় জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।’
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সমুদ্রনির্ভর। বাংলাদেশের আমদানি-রফতানির ৯০ শতাংশই সম্পাদিত হয় সমুদ্রপথে। এ ছাড়া বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় দুই হাজার ৬০০ জাহাজের মাধ্যমে ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি-রফতানি হয়। এসব জাহাজ থেকে ভাড়া বাবদ আয় হয় ছয় বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ। এসব জাহাজের অধিকাংশই বিদেশি মালিকানাধীন। ভবিষ্যতে এসব সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বিস্তৃত হবে কর্মসংস্থান।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরেকারের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্রমশ দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনা ও সঠিক উদ্যোগ থাকতে হবে সরকারের। এসব উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের দিকেও নজর রাখতে হবে। কঠোর নজরদারিও করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্টদের। জিডিপিকে সমৃদ্ধ করে— এমন নতুন খাত খুঁজে বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমুদ্রে বাংলাদেশের নতুন জলসীমা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সমুদ্রের উপরিভাগসহ সমুদ্রের তলদেশে থাকা সম্পদ কাজে লাগাতে পারলে তা জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমি মনে করি।’
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আগামীতে বাংলাদেশ হবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আর এটি করতে হলে শুধু সমুদ্র নয়, যেখানেই সম্ভাবনা রয়েছে সেখানেই বিনিয়োগ বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নতুন নতুন সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে হবে। তবে সমুদ্র অর্থনীতি কাজে লাগাতে পারলে তা জিডিপিকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করবে।’