মধ্যপ্রাচ্য: সৌদি আরবের সিংহাসন নিয়ে খেলা

মাত্র কদিন আগে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান তাঁর ভাতিজা মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে নিজের ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স, অর্থাৎ যুবরাজ ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেন, যা শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর নিজের সিংহাসনে আরোহণের মধ্য দিয়ে।

প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (৩১) বাদশাহ সালমানের খুবই প্রিয় সন্তান। পশ্চিমে তিনি এমবিএস নামে বেশি পরিচিত। তাঁকে যুবরাজ পদে নিয়োগ দিয়ে বাদশাহ সালমান (৮১) কার্যত মরহুম বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের ছেলেদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলার কয়েক দশকব্যাপী ঐতিহ্য থেকে সরে আসার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন।

কাঠামোগতভাবে সৌদি আরবে আর ক্ষমতার ভাগাভাগি হবে না। দেশটি এখন নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রে ফিরেছে। ক্ষমতা এখন সম্পূর্ণভাবে বাদশাহর হাতে কেন্দ্রীভূত এবং তিনি এই ক্ষমতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর কোনো ছেলের কাছে দিয়ে যাবেন।

তবে বাস্তবে মোহাম্মদের যুবরাজ পদে এই নিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে গতিশীল করবে এবং বহু উপাদানবিশিষ্ট, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ শক্তি কেন্দ্রগুলোর যে স্বাভাবিক রাজনৈতিক ঝুঁকি রয়েছে, তাকে প্রশমিত করবে। তবে এই নতুন ব্যবস্থার যেমন সুবিধা আছে, তেমনি এতে ক্ষতির আশঙ্কাও আছে। কারণ, সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তগুলো তর্কাতীত ও প্রশ্নাতীত থেকে যেতে পারে।

বাদশাহ সালমান মারা গেলে যুবরাজ মোহাম্মদ বাদশাহ হবেন। ক্ষমতার পথে তাঁর উত্থান ২০০৯ সালে। সে সময় তিনি তাঁর বাবার উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। তখন তাঁর বাবা ছিলেন রিয়াদের গভর্নর। যুবরাজ হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হচ্ছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় চমক। সিংহাসনে আরোহণের প্রতিযোগিতায় মোহাম্মদ জয়ী হয়েছেন, যেখানে কিনা আরও শত শত প্রিন্স ছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগই মোহাম্মদের চেয়ে বয়সে বড় ও অভিজ্ঞ এবং তাঁরা মনে করতেন, ভবিষ্যতে তাঁরাই বাদশাহ হিসেবে নির্বাচিত হবেন।

এটা ঠিক যে বাদশাহর পক্ষপাতিত্ব সুস্পষ্টভাবে মোহাম্মদের সিংহাসনে আরোহণের পথ সুগম করেছে। কিন্তু এটাই তাঁর সাফল্যের একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। সৌদি সমাজের প্রধান ক্ষেত্রগুলোর ওপর তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তাঁর ক্ষমতা সুসংহত করতে মোহাম্মদকে তাঁর বুদ্ধি, চাতুর্য ও ব্যক্তিত্বের ওপর ভরসা করতে হয়েছিল। এই প্রধান ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজপরিবার, ব্যুরোক্র্যাট ও টেকনোক্র্যাট-গোষ্ঠী, গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, বৃহৎ জাতীয় তেল কোম্পানি সৌদি আরামকো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

সৌদি রাজপরিবারের কঠোর প্রটোকল এবং প্রাধান্যপরম্পরার বিষয়টি কঠিনভাবে মেনে চলেই মোহাম্মদ এসব করছিলেন। এই বিষয়টি আমাদের ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে কেন যুবরাজের পদটি একজন থেকে মসৃণভাবে আরেকজনের কাছে চলে গেল। বহুল প্রচারিত একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, সদ্য যুবরাজ পদ থেকে বরখাস্ত হওয়া প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নাইফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর হাতে চুমু খাচ্ছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

মোহাম্মদের দ্বিতীয় বড় অর্জন হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতিতে, যেখানে তিনি তাঁর সক্ষমতা তাঁর বাবার কাছে প্রমাণ করতে পেরেছেন। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পরপরই প্রিন্স মোহাম্মদ রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বৈঠকের উদ্যোগ নেন। তাঁরই একান্ত প্রচেষ্টায় গত মে মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরব সফর করেন। ট্রাম্পের সফর সৌদি আরবের জন্য একটি বড় বিজয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে সৌদি-মার্কিন সম্পর্ক নিম্নতম পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু এখন সেটা স্বাভাবিক হয়েছে। ট্রাম্প তাঁর সৌদি সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরবের কৌশলগত সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং দেশটির সঙ্গে বেশ কয়েকটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যেগুলোর মূল্যমান কয়েক শ কোটি ডলার।

যুবরাজ মোহাম্মদ সৌদি আরবের জন্য দুটি বড় লক্ষ্য স্থির করেছেন। প্রথমটি হচ্ছে ভিশন ২০৩০ নামে একটি কর্মসূচির বাস্তবায়ন, যার মাধ্যমে সৌদি অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসবে। তিনি চান তেলের রাজস্বের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে এবং তেলক্ষেত্রের বাইরে অন্যান্য ক্ষেত্রে ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে। নতুন যুবরাজ মনে করেন, বিকল্প জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির উত্থানের ফলে ভবিষ্যতে সৌদি আরবের বিশাল তেলের ভান্ডারের মূল্য খুব একটা থাকবে না। ভিশন ২০৩০-এর আওতায় মোহাম্মদ চেষ্টা করবেন সৌদি আরবের তেলের ভান্ডার থেকে যতখানি সম্ভব আয় করতে। এই অর্থ তারপর দেশের অ-তেল খাতের উন্নয়নে বরাদ্দ করবেন এবং তেলের রাজস্ব আয় যে অনিবার্য ক্ষতির মুখে পড়বে, তা পূরণের জন্য সমুদ্র উপকূলবর্তী সম্পদে বিনিয়োগ করবেন। প্রিন্স মোহাম্মদ ২০১৮ সালে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি সৌদি আরামকোর একটি অংশকেও বেসরকারীকরণ করতে আগ্রহী।

মোহাম্মদের দ্বিতীয় বড় লক্ষ্য হচ্ছে সৌদি আরবকে একটি আঞ্চলিক সামরিক শক্তিতে পরিণত করা, যাতে দেশটি ইরানসহ বাইরের যেকোনো দেশের হুমকি মোকাবিলা করতে পারে। এ জন্য তাঁকে তাঁর দেশকে এমন একটি দেশে পরিণত করতে হবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সুরক্ষার ওপর বেশি নির্ভরশীল হতে না হয়। সৌদি আরব ১৯৪৫ সাল থেকে তার সামরিক সুরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল।

নতুন যুবরাজের এসব লক্ষ্য পূরণ হতে এক দশক বা তার চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে। তবে এখন তাঁর ক্ষমতার ভিত্তি মোটামুটি নিশ্চিত এবং মনে হচ্ছে তিনি তাঁর প্রতিটি লক্ষ্যই পূরণ করবেন।

বার্নার্ড হেইকেল: যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির নিয়ার ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক। অনুবাদ: রোকেয়া রহমান।