হাওড় বিপর্যায়: ‘সেহরিতে মরিচ পোড়া-পানি ভাত, ইফতারে রুটি আর শাকপাতা’

সুনামগঞ্জ: ‘সেহরি খাইছি মরিচ পোড়া আর পানি ভাত দিয়া, ইফতার করমু রুটি ও শাকপাতা দিয়া। আর কোনও উপায় নাই। গোলায় ধান নাই, হাওরে মাছ নাই, কোথাও কোনও কাজ-কাম নাই। ব্যাটাইনরে বাজারের কথা কই না’- এভাবেই নিজের দুর্ভোগের কথা বলছিলেন সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের লালপুর গ্রামের সুর্য্যা বানু। আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের একজন এই গৃহবধূ ও তার পরিবার।

সুর্য্যা বানু নিম্নধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিনী। বাড়ির পাশের হাওরে অনেক কষ্ট করে ৭ কেয়ার জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু চৈত্রের আগাম বন্যায় ক্ষেতের কাঁচা ধান তলিয়ে গেছে। এখন সংসার চালানোর কোনও সামর্থ্য অবশিষ্ট নেই। এর মধ্যেই এসেছে রমজান মাস। কিন্তু  রোজার আগে থেকেই সুর্য্যা বানু ও তার পরিবার তীব্র অভাব অনটনের মধ্যে দিনযাপন করছেন। এর ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। ফলে সেহরিতে মরিচ পোড়া আর পানি ভাত খেয়েই রোজা থাকতে হচ্ছে। আর রোজা ভাঙতে হচ্ছে ইফতারে রুটি ও শাকপাতা খেয়ে।

আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পুরো লালপুর গ্রাম ঘুরে দরিদ্র্য পরিবারগুলোতে ইফতার সামগ্রী তৈরির কোনও দৃশ্যমান ছবি চোখে পড়েনি। তবে স্বচ্ছল ও চাকরিজীবি পরিবারে দেখা গিয়েছে কিছুটা আয়োজন। বছরের শুরুতে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলার ছোট বড়ো ১৪২টি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ১ লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর জমির কাঁচাধান পানিতে তলিয়ে যায়। এতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলহানিতে জেলার ৩ লাখ কৃষক ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েছেন। খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলায় দেখা দেয় তীব্র খাদ্য সংকট। লালপুর গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোর একটি।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা সরেজমিনে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেখে গেছেন। এছাড়া সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সুনামগঞ্জ সফর করে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবাসীর তুলনায় ত্রাণের পরিমাণ অপ্রতুল হওয়াতে বিতরণকারীরাও বিপাকে পড়েন। এছাড়া সম্প্রতি শিলাবৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড়ে জেলায় ব্যাপক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকেই এখনও অন্যের বাড়িতে আশ্রয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

লালপুর গ্রামের ৬০ বছরের গৃহবধূ মোমেনা খাতুনের কাছে রোজা কেমন চলছে জানতে চাইলে জানান, গতবছর একসপ্তাহ আগেই ইফতারের বাজার করেছিলেন। এ বছর তেল, ছোলা, ডাল এসবের কোনও কিছুই কেনার সামর্থ্য নেই। তাই হিদল, শুটকি ভর্তা আর কাঁচামরিচ দিয়ে কোনও রকমে সেহরি খেয়ে রোজা রাখছেন। মৎস্যজীবী প্রধান গ্রামটির আরেক গৃহবধূ আমেনা খাতুন (৩৫) জানান, আগাম বন্যায় বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে। হাওরের পঁচা পানিতে মাছ মরে গেছে। হাঁসেরও মড়ক দেখা দিয়েছিল। তাই হাওরে আগের মতো মাছ নেই, আয়-রোজগারও নেই। সরকারি ত্রাণের উপর ভরসা করে সংসার চলছে। আম্বিয়া খাতুন (৪৩) নামের গৃহবধূ জানান, সব দিক থেকেই সমস্যায় রয়েছেন তারা। মাছ ধরার জাল-নৌকা কেনার মতো সামর্থ তাদের নেই। ঘরে একমুঠো খাবারও নেই। কোনও রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন লালপুর গ্রামের বাসিন্দা তাসলিমা আক্তার লিমা। তিনি বলেন, ‘সরকার তো চাল ছাড়া আর কোনও ত্রাণ দিচ্ছে না। তাই রোজার শুরুতে ক্ষতিগ্রস্তরা সীমাহীন কষ্টের মধ্যে রোজা পালন করছেন। এজন্য বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ইফতার তৈরির তেল, ডাল ছোলা সরবরাহ করলে কৃষকরা উপকৃত হতেন।’ গৌরারং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফুল মিয়া বলেন, ‘হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য যে ত্রাণ সামগ্রী দেয়া হচ্ছে তা অপ্রতুল। কেউ পায় তো কেউ পায় না। সরকার যদি ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ডের সংখ্যা দ্বিগুণ করে খাদ্যবান্ধব কর্মসুচি ব্যাপকভাবে চালু করে তাহলে হাওরবাসী কিছুটা স্বস্তি পাবেন।’ রমজানে বেসরকারি ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থা ও সংগঠনসহ সমাজের বিত্তবানদের দরিদ্র্য মানুষের জন্য ইফতার সামগ্রী বিতরণের আহ্বান জানিয়েছেন তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল।

জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবাসীর জন্য সরকারি ত্রাণ সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ইফতার সামগ্রী বিতরণের কোনও নির্দেশনা এখন পর্যন্ত নেই।’