বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক নিধনযজ্ঞ থামেনি: এখনো আসছে রোহিঙ্গারা

ঢাকা: বৌদ্ধদের নির্যাতনের কারণে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে এখনো আসছে রোহিঙ্গারা। গত এক সপ্তাহে ৫ শতাধিক রোহিঙ্গা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গাকে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। চলে আসা এসব রোহিঙ্গারা জানান, আরাকানে নতুন করে নির্যাতন ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া শুরু করেছে সে দেশের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধ মগরা।

বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের চুক্তি সইয়ের পর রোহিঙ্গাদের যখন স্বদেশে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে ঠিক সে মুহূর্তে আরাকানে নতুন করে শুরু হয়েছে রোহিঙ্গা নিধন। যার কারণে চলমান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দুদিন আগে আসা রোহিঙ্গারা বলেছেন, মিয়ানমারের আরাকানের রোহিঙ্গাপল্লিতে এখনও নানা নির্যাতন চালানো হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে ব্যাপক খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা পালিয়ে সীমান্তের নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের তাদের দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা তার উল্টো। তবে চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের পক্ষে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক তালিকা করা হচ্ছে।

উখিয়ার কুতুপালং টিভি রিলে কেন্দ্রের পাশে অবস্থিত ট্রানজিট রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা হয় দুদিন আগে আরাকান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সঙ্গে।

তিনি বলেন, নিজ গ্রাম আরাকানে চাকমাপাড়া থেকে অনেকেই বাংলাদেশে চলে আসলেও এতদিন আমরা আসিনি। কারণ, কষ্ট হলেও থাকতে পারলে অন্তত নিজ বাড়িতে থাকাটা আলাদা। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে সেনাবাহিনী তার স্বামীকে বাড়ি থেকে তুলে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার আর কোনো খোঁজ পাইনি। পরে উগ্রপন্থি বৌদ্ধ মগের ছেলেরা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ছোট ছেলেকে জ্বলন্ত আগুনে ছুড়ে মারে। এতে কোনমতে আগুনে পুড়ে যাওয়া সন্তানসহ অন্যদের নিয়ে মংডুর ডংখালী সীমান্ত দিয়ে আসি।

একইভাবে মিয়ানমারের আরাকানের রাচিদং থানার সাংগুদাইন গ্রাম থেকে বাংলাদেশে আসে একজন। তিনি বলেন, আরাকানে আবারও ধরপাকড় শুরু হয়েছে। নতুন করে নির্যাতন শুরু হওয়ায় গত তিন দিন আগে একসঙ্গে ১০৭ জন রোহিঙ্গা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।’

তাদের মতো গত এক সপ্তাহে এসেছে প্রায় ৫ শতাধিক রোহিঙ্গা। তারা প্রত্যেকে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন অফিস কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, এখনও প্রতিদিন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। আগের মতো ব্যাপক হারে না আসলেও প্রতিদিন ২-৩ শত রোহিঙ্গা আসছে। অথচ চুক্তিতে বলা ছিল মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখতে পাইনি।’
এ বিষয়ে গত সোমবার কক্সবাজার সফরে এসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি রোহিঙ্গারা নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশে চলে আসছে। এতে আমাদের করার কিছুই নেই। গত ৪০ দিনে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। গত কয়েক দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ জন করে রোহিঙ্গা এসেছে। আমরা যতটুকু জেনেছি, মিয়ানমারের কিছু লোক তাদের বলছে, অন্যরা যেহেতু বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে, তোমরাও চলে যাও। সে কারণে তারাও বাংলাদেশে আসছে। আবার অনেকেই আসছে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের খুঁজতে। এতে আমরা বিচলিত নই। প্রত্যাবাসন যখন শুরু হবে তখনও যদি রোহিঙ্গা আসা অব্যাহত থাকে তখন আমাদের সিরিয়াসলি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে গত ২৪ নভেম্বর। চুক্তির দুই মাসের মাথায় প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুই দেশের প্রস্তুতি না থাকায় প্রত্যাবাসন পিছিয়ে যায়। দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আরাকানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে যথাযথ প্রস্তুতি এবং নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করলেও এখনও আরাকানে রোহিঙ্গাপল্লিতে নানাভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। চুক্তির পর গত আড়াই মাসে আইওএম ও সরকারের দেয়া তথ্যমতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গারা বলছে, মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ নানা নির্যাতন চালিয়ে তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে। ক্ষেতের ফসল লুট করা হয়েছে। খাদ্য সংকট তৈরি করা হয়েছে।