মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার: বাস্তবায়নকারী সংস্থার অদক্ষতায় ত্রুটিপূর্ণ নকশা গ্রহণ

নিউজ নাইন২৪ডটকম, ঢাকা: মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় নেই ওঠানামার র্যাম্প। ছিল না ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থাও। ফ্লাইওভারটি নির্মাণও হয়েছে উল্টো নকশায়। অথচ নকশা প্রণয়নকালে এসব ভুল ধরতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এজন্য সংস্থাটির অদক্ষতাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার প্রকল্পটির পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রেও মানা হয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত।

২০১০ সালে মালিবাগ-মৌচাক রেলক্রসিংয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রস্তাব করে সওজ। সে বছর জুনে ঢাকার যানজট নিরসন-সংক্রান্ত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিষয়টি উত্থাপন করে সংস্থাটি। তাতে আপত্তি জানিয়ে ফ্লাইওভারটি বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায় এলজিইডি। অথচ বড় কোনো অবকাঠামো নির্মাণের অভিজ্ঞতা সংস্থাটির নেই। এমনকি এক দশকে কোনো ফ্লাইওভার নির্মাণও করেনি তারা। এর পরও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারটি বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি। ফলে বাস্তবায়নকালে ফ্লাইওভারটির নানা সমস্যাও সামনে আসতে শুরু করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূল নকশায় মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে ভূমিকম্প ঝুঁকি প্রতিরোধ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না এলজিইডির। তবে গত বছর বিষয়টি চিহ্নিত করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হয় নকশায়, যা সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হয়।

প্রকল্পটির সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ফ্লাইওভারে ভূমিকম্প প্রতিরোধী কোনো ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিধান ছিল না। নকশায় ‘ইলাস্টিক প্যাড বেয়ারিং’ ব্যবহারের বিধান রাখা হয়, যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না। তবে বুয়েটের পরামর্শে পরবর্তীতে নকশায় ‘পট বেয়ারিং অ্যান্ড শক ট্রান্সমিশন ইউনিট’ সংযোজন করা হয়। এগুলো ৯ হাজার ৫০০ কিলোনিউটন-ক্ষমতার ঝাঁকুনি ধারণ করতে সক্ষম। ফলে বড় ধরনের ভূমিকম্পেও ফ্লাইওভারের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

এদিকে ফ্লাইওভারের নকশা প্রণয়নের আগে মাটির গুণগত মানও (সয়েল টেস্ট) ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। এটিও জানা ছিল না এলজিইডির। ফলে কাজ শুরুর পর লোড টেস্ট করে পাইলিংয়ের গভীরতা বাড়ানোর পরামর্শ দেয় বুয়েট। এর বাইরেও বেশকিছু উপকরণ প্রকল্পটিতে নতুন করে যুক্ত করা হয়।

স্থপতি ইকবাল হাবিব এ প্রসঙ্গে বলেন, ফ্লাইওভারটি নির্মাণের দায়িত্ব দেয়ার আগে এত বড় অবকাঠামো নির্মাণের দক্ষতা এলজিইডির আছে কিনা, তা যাচাই করা দরকার ছিল। সংস্থাটি এক দশকের বেশি আগে খিলগাঁও ফ্লাইওভার নির্মাণ করলেও তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। মূলত গণশুনানি ছাড়া এ ধরনের বড় অবকাঠামো নির্মাণ করায় নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই জবাবদিহিতার বাইরে গিয়ে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ সামগ্রিকভাবে মঙ্গল বয়ে আনবে না।

তবে অদক্ষতার বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করেননি তত্কালীন প্রকল্প পরিচালক ও এলজিইডির সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. হায়দার আলী। তিনি বলেন, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা দেশীয় কোনো প্রকৌশলী প্রণয়ন করলে নিশ্চিত তাকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হতো। তবে বিদেশী প্রকৌশলী হওয়ায় নকশা প্রণয়নকারীরা বেঁচে গেছেন।

এদিকে নকশা ত্রুটির কারণে ফ্লাইওভারটিতে ওঠানামায় বড় ধরনের অসুবিধা হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, গুরুত্বপূর্ণ ১৮টি পয়েন্টে ডানে মোড় নেয়ার র্যাম্প থাকা দরকার। কিন্তু মাত্র একটি মোড়ে এ সুযোগ রাখা হয়েছে। মগবাজার মোড়, শান্তিনগর, হাতিরঝিল মোড়, বিশ্বরোড ইন্টারসেকশন ও টঙ্গী ডাইভারশন রোডের মতো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় গাড়ি ওঠানামার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আবার মালিবাগ-মৌচাকেও দুটি র্যাম্প রাখা হয়েছে। অথচ প্রয়োজন ছিল আটটি। এতে ফ্লাইওভারে না উঠে নিচ দিয়ে প্রচুর গাড়ি চলাচল করবে। ফলে নিচের সড়কে আগের মতো যানজট লেগেই থাকবে।

এ বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, ফ্লাইওভারটি দিয়ে কেউ শান্তিনগর থেকে সাতরাস্তা যেতে চাইলে প্রথমে ইস্কাটন নামতে হবে। এর পর নিচের সড়ক দিয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল পেরিয়ে ভিআইপি সড়ক থেকে ডানে মোড় নিয়ে আবার ফ্লাইওভারে উঠতে হবে। অথবা নিচের সড়ক দিয়ে সাতরাস্তা যেতে হবে। আবার সাতরাস্তা থেকে মালিবাগ যেতে চাইলে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনে নেমে অনেকটা পথ ঘুরতে হবে। মূলত ডানে মোড় নেয়ার র্যাম্প না থাকায় এটি হয়েছে। তাই ঝামেলা এড়াতে অনেকেই ফ্লাইওভারের পরিবর্তে নিচের সড়ক ব্যবহার করবে। এতে নিচের সড়কে যানজট কমার সম্ভাবনা নেই।

তবে ফ্লাইওভারটি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না বলে মনে করেন বর্তমান প্রকল্প পরিচালক মো. নাজমুল আলম। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে মগবাজার-মৌচাক-শান্তিনগর একটি ব্যস্ততম এলাকা। তাই নিচের সড়ক উন্মুক্ত রাখতে একটি পিলারের ওপর তিনতলা করা হচ্ছে। ফলে নিচের সড়ক দিয়ে সহজেই অনেক যানবাহন চলাচল করতে পারবে। আর যানজট না কমলেও ওপরে থাকা ফ্লাইওভারটি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না।

জানা গেছে, ফ্লাইওভারটির প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কম যোগ্যতাসম্পন্ন একজন প্রকৌশলীকে নিয়োগ দিয়েছে এলজিইডি। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত জনবল কাঠামো (অর্গানোগ্রাম) অনুসরণ করা হয়নি।

২০১০ সালের নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের জনবল কাঠামো অনুমোদন করা হয়। এতে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদমর্যাদাসম্পন্ন (গ্রেড-৪) একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি তিনজন জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী (গ্রেড-৬) ও তিনজন উপসহকারী প্রকৌশলী (গ্রেড-১০) নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।

তবে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নির্বাহী প্রকৌশলী পদমর্যাদাসম্পন্ন (গ্রেড-৫) মো. নাজমুল আলমকে নিয়োগ করে এলজিইডি। এছাড়া তিনজন জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলীর পরিবর্তে একই গ্রেডের আরো তিনজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর তিনজন উপসহকারী প্রকৌশলীর পরিবর্তে দুজন জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলীকে নিয়োগ দিয়েছে এলজিইডি।