বিপুল অপচয় থেকে রেহাই চায় ভর্তি পরীক্ষার্থীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন প্রায় ৫০টি। শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। তীব্র প্রতিযোগীতাও চলছে। ভর্তি নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরাও মরিয়া। একাধিক প্রতিষ্ঠানে ভর্তিযুদ্ধে লিপ্ত হতে হচ্ছে সদ্য কলেজ পেরোনো তরুনরা। এর মধ্যে আবার দুর্ভোগ হিসেবে রয়েছে যানজট। খুব অল্প সময়ে ৫৫ হাজার বর্গমাইলজুড়ে আসা-যাওয়া দুরূহ। সচরাচর অভিভাবকদেরও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সফরে যেতে হয়। লাখ লাখ মানুষ একই সময়ে এক স্থানে গিয়ে থাকা-খাওয়ার মুশকিলে পড়ে। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। ভর্তি মৌসুমে এক তারিখে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়েও পরীক্ষা থাকে। এতে শিক্ষার্থীরা অনেক পছন্দের জায়গায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান না।

এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার দাবী তুলেছেন। তাদের মতে, অভিন্ন ব্যবস্থা হলে সময় ও অর্থ বাঁচত সব পরীক্ষার্থীর। সবাই নিজ জেলায় পরীক্ষা দিতে পারতেন। দূরদূরান্তে যাওয়ার মানসিক চাপ ও হয়রানি থেকেও রেহাই মিলবে। অভিভাবকেরাও পরিত্রাণ পাবেন দৌড়াদৌড়ির দুর্ভোগ থেকে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আয়োজনের কোলাহল থেকে মুক্তি পেত।

বিশেষজ্ঞ বলছেন, সরকার থেকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় আগ্রহ দেখালেও একটি মহল এই পদ্ধতির বিরোধীতা করছে। স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় লাভ কেবল গুটিকয়েক শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের। সঙ্গে আছেন গাইড লেখক, পরিবহন ব্যবসায়ী এবং টাকা লেনদেনের মোবাইল অপারেটররা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা পরীক্ষার ন্যায্যতা হিসেবে মৃদু কিছু স্বাতন্ত্র জারি রেখেছে। এই ভিন্নতাকে ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে জেলা পর্যন্ত শত শত কোচিং ঘর। বের হচ্ছে হরেক গাইড। শিক্ষার্থীরা ভর্তি নিশ্চিত করতে প্রায় সবাই একাধিক কোচিংয়ে যান, গাইড বই কেনেন। কোচিং ব্যবসায়ীরাও আয় নিশ্চিত করতে তিন মাসের পুরো কোচিং ফি শুরুতেই নিয়ে নেন। এ রকম ফি ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যদি ৩ লাখ শিক্ষার্থী ২০ হাজার করেও কোচিংয়ে ব্যয় করেন, তাহলে কেবল এ থেকে কোচিং সেন্টারগুলোর আয় ৬০০ কোটি টাকা।

যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ভর্তিতে একটা জাতীয় শৃঙ্খলাও আসবে। বর্তমানে যেভাবে ভর্তি মৌসুম শুরু হয়, তা নৈরাজ্যময়। কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয় পৃথক দিনে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, পৃথকভাবে আবেদন চাইছে। গ্রামগঞ্জের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞাপন দেখা, আবেদন করা সহজ নয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আবার অনেকগুলো অনুষদ করে পৃথকভাবে আবেদন চায়। পুরো প্রক্রিয়ায় গণব্যবসায়ের আলামত। নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য যা বিড়ম্বনাস্বরূপ।

অন্যদিকে, ৩ লাখ শিক্ষার্থী যদি ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ৫টিতে ২টি করে অনুষদে আবেদন করেন, তাতেই খরচ ৩০০ কোটি। অনুষদপ্রতি গড়ে এক হাজার টাকা করে এই হিসাব করা হলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ আরও বেশি। আছে ‘বিকাশ’, রকেট’ আর কম্পিউটার সেন্টরগুলোর খরচও। অনেক শিক্ষার্থী ১০-১৫ জায়গায়ও আবেদন করছেন। গাড়ি ভাড়া, হোটেল ভাড়া, খাবার খরচ মিলে ৩ লাখ অভিভাবকের ব্যয়ের অঙ্কটি অনেক বড়। এ রকম প্রক্রিয়া শেষে আবার দেখা যায়, শত শত আসন খালি থাকছে। অনেক শিক্ষার্থী এক স্থানে বাছাই হয়েও অপর বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করেন। আরেক দল এভাবে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। নীরব একজাতীয় অপচয় এটা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থের লোভ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত প্রবল হয়েছে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এক অনুষদ ভেঙে কয়েকটি বিভাগ নিয়ে আরেক অনুষদ বানাচ্ছে। এসব অনুষদে আলাদা ফি দিয়ে আলাদা পরীক্ষা হয়। ঢাকার নিকটবর্তী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের কেবল একটি বিষয়ের ১৫০টি আসনের জন্য পৃথক অনুষদ তৈরি করা হয়েছে। সেখানেও লাখো শিক্ষার্থীকে পৃথকভাবে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে আবেদন করতে হচ্ছে। একটি বিষয়ের জন্য ১০ শিফটে পরীক্ষা হচ্ছে ১০ রকমের প্রশ্ন দিয়ে। ১০ রকমের পরীক্ষায় একই পদের জন্য মান যাচাই বিস্ময়কর। হয়তো টাকার ক্ষুধার জন্যই এমন কিছু।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, ভর্তি ফি নির্ধারণে নৈরাজ্যের স্বীকার হতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। কর্তাব্যক্তিরা ইচ্ছেমতো সেটা ঠিক করছেন। অনেক স্থানে ফি নেওয়ার পরও প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষার আগেই অনেককে বাদ দেওয়া হয়। যাঁকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হচ্ছে না, তার ফি নেওয়ার কোনো ব্যাখ্যাও মিলছে না। এসব অনাচার চলছে স্বায়ত্তশাসনের নামে। প্রশ্নপত্র তৈরিতেও আছে বিপুল খামখেয়ালি। শিক্ষার্থীদের এই গিনিপিগ অবস্থায় মঞ্জুরি কমিশন দর্শকের ভূমিকায়। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তিপ্রক্রিয়া থেকে গড়ে ১০-১২ কোটি টাকা আয় করলেও কী প্রক্রিয়ায় তা বিলিবণ্টন হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজস্ব কোষাগারে তার কতখানি জমা পড়ছে, সে বিষয়ে মঞ্জুরি কমিশনই ভালো বলতে পারবে।