ভুল নকশা ও অব্যবস্থাপনায় চলাচল অযোগ্য ঢাকার ফুটপাত

ঢাকা: ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ার পরও মতিঝিলের ফুটপাতগুলোর প্রস্থও পাঁচ ফুটের কম। স্বল্প প্রশস্তের এ ফুটপাতগুলো আবার হকারদের দখলে।

ফার্মগেট-মতিঝিলই শুধু নয়, একই অবস্থা পুরো রাজধানীর অধিকাংশ ফুটপাতেরই। কোথাও প্রস্থ কম, কোথাও আবার মূল সড়ক থেকে ফুটপাতের উচ্চতা অনেক বেশি। ফুটপাতের ওপর রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ড। রয়েছে ফুটওভার ব্রিজ, ডাস্টবিন ও ম্যানহোল।

ফুটপাতের এ ভুল নকশায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে পথচারীদের। যদিও রাজধানীর প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ যাতায়াত করে হেঁটে, ফুটপাত দিয়ে।

রাজধানীর মোট ট্রিপের (যাতায়াত) প্রায় ১৮ শতাংশ হয় হেঁটে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তৈরি ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের খসড়া অনুযায়ী, বর্তমানে রাজধানীতে মোট ট্রিপ হয় প্রায় সাড়ে তিন কোটি। এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ হয় হেঁটে। বাকি ট্রিপের ৭ দশমিক ২২ শতাংশ হয় ব্যক্তিগত গাড়িতে, ৩৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ বাসে, ৩৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ রিকশায়, দশমিক ২৫ শতাংশ রেল ও নৌপথে এবং দশমিক ১৪ শতাংশ অন্যান্য মাধ্যমে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার প্রায় কোনো অঞ্চলেই সঠিক পরিকল্পনায় ফুটপাত হয়নি। রাজধানীর অধিকাংশ ফুটপাতই সড়ক থেকে দেড় ফুটের বেশি উঁচু। যদিও সারা বিশ্বে তা ৬-৯ ইঞ্চি হয়ে থাকে। প্রস্থেও আদর্শ মানের চেয়ে কম রাজধানীর অধিকাংশ ফুটপাত।

বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বাইকিং ও ফুটপাত ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পলিসি (আইটিডিপি)। তাদের নকশা অনুযায়ী, আবাসিক অঞ্চলে ফুটপাতের মূল প্রশস্ততা হবে ন্যূনতম ছয় ফুট। এর সঙ্গে ফ্রন্টেজ জোন (উঁচু অংশ) ও ফার্নিচার জোন (বসার জায়গা) যোগ করলে আবাসিক এলাকায় ফুটপাতের ন্যূনতম প্রস্থ হবে ১০ ফুট। এ নকশা অনুযায়ীই ফুটপাত নির্মাণ করে চীন, ভারত, ব্রাজিল, কেনিয়া, মেক্সিকোসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ।

আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, ফুটপাতে হাঁটার অংশটি এমন হবে, যাতে দুজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী পাশাপাশি চলতে পারে। এছাড়া চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়, এমন কোনো প্রতিবন্ধকতাও সেখানে থাকতে পারবে না।

রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাত ঘুরে দেখা যায়, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ধানমন্ডি সাতমসজিদ সড়ক পর্যন্ত ফুটপাতটিতে হাঁটাও দুষ্কর। উঁচু-নিচু, ভাঙাচোরা ফুটপাতের ওপরই রয়েছে বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথ।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমাদের দেশে ফুটপাত নির্মাণের পরিকল্পনা ও নকশায় বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে। ফুটপাতগুলোর কোথাও উঁচু, কোথাও আবার নিচু। এছাড়া ফুটপাত দখল করে নানা স্থাপনাও রয়েছে। এতে পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচল সম্ভব হয় না। এ সমস্যা সমাধানে এখন যেটা প্রয়োজন, তা হলো সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ।

বাণিজ্যিক অঞ্চলের ফুটপাতের জন্যও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পৃথক আদর্শ মান রয়েছে। আইটিডিপির তথ্য অনুযায়ী, বাণিজ্যিক অঞ্চলে ফুটপাতের মূল অংশের (চলাচলের জন্য) প্রস্থ হবে ন্যূনতম ৮ দশমিক ২ ফুট। এর সঙ্গে ফ্রন্টেজ ও ফার্নিচার জোন যোগ করলে বাণিজ্যিক অঞ্চলে ফুটপাতের প্রস্থ হবে কমপক্ষে ১৬ দশমিক ৮ ফুট। অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক অঞ্চলের জন্য ফুটপাতের মূল অংশের প্রস্থ হবে ১৩ দশমিক ১২ ফুট। ফ্রন্টেজ ও ফার্নিচারসহ এ ধরনের বাণিজ্যিক অঞ্চলে ফুটপাতের প্রস্থ হবে ন্যূনতম ২১ দশমিক ৩ ফুট।

ফুটপাতের ভুল নকশার বিষয়টি স্বীকার করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল। তিনি বলেন, পুরনো ফুটপাতগুলোর অধিকাংশের নকশায় ত্রুটি রয়েছে। ফলে এসব ফুটপাত দিয়ে বাধাহীনভাবে চলাচল করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি। শিগগিরই পুরনো ফুটপাতগুলো মেরামত করা হবে। কিছু ফুটপাত নতুন করেও তৈরি করা হবে। এজন্য দরপত্র প্রক্রিয়া চলছে। আশা করছি, আগামী শীতের মধ্যে এগুলোর কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।

ভুল নকশার পাশাপাশি রাজধানীর ফুটপাতগুলো চলাচলের অনুপযোগী হওয়ার আরো কিছু কারণ রয়েছে। ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানেও বিষয়টি উঠে এসেছে। এর মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করা। এতে অপ্রশস্ত ফুটপাতগুলোর ধারণক্ষমতা আরো কমে আসছে। এছাড়া ফুটপাতজুড়ে রাখা হচ্ছে নির্মাণসামগ্রী। রিকশাস্ট্যান্ড ও যানবাহনের গ্যারেজ হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে কোনো কোনো ফুটপাত। রয়েছে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলও।

ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের (আইএবি) সভাপতি স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে পথচারীদের কথা মাথায় রেখে ফুটপাত তৈরি হয় না। সড়ক থেকে ফুটপাতগুলোর উচ্চতা অনেক বেশি, চলাচলের জন্য যা মোটেও উপযোগী নয়। অন্যান্য দেশের ফুটপাত সড়ক থেকে সাধারণত ৬-৯ ইঞ্চি উঁচু হয়ে থাকে। আমাদের দেশে ক্ষেত্রভেদে সড়ক থেকে দেড় ফুটের বেশি উঁচু ফুটপাতও রয়েছে। এছাড়া ফুটপাতগুলোর প্রস্থও অনেক কম। এ কারণে ফুটপাত দিয়ে চলাচলে বেগ পেতে হয় পথচারীদের। – বণিক বার্তা