রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস: এক বছরে কমেছে ৫০০০ কোটি টাকা

 

ঢাকা: দেশের বেশির ভাগ রেমিট্যান্স আসে মধ্যপ্রাচ্যের আটটি দেশ থেকে। গত অর্থবছরে আটটি দেশের মধ্যে ছয়টি থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া তথ্য মতে সৌদি আরব থেকে ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা এবং আরব আমিরাত থেকে ৮৭২ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশীক মুদ্রা কমে গেছে। সব মিলিয়ে ছয় দেশ থেকে এক বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশীক মুদ্রা।

এদিকে শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে না, কমে গেছে দেশের ২৮ সরকারি, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের রেমিট্যান্স আহরণ। ব্যাংকগুলোর সমাপ্ত অর্থবছরের রেমিট্যান্স আহরণ আগের অর্থবছর (২০১৪-১৫) থেকে কমে গেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, বেসিক ও কৃষি ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, স্টান্ডার্ড ব্যাংক, ইউসিবিএল, উত্তরা, এবি, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা, আএফআইসি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে তার দু-তৃতীয়াংশ আসে মধ্যপ্রাচ্যের আটটি দেশ থেকে। আবার মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বেশির ভাগ আসে সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও কুয়েত থেকে। কিন্তু সমাপ্ত অর্থবছরে দেশভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, রেমিট্যান্সের প্রধান বাজার এ তিন দেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে কম এসেছে অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে সমাপ্ত অর্থবছরে এ দেশ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ কমেছে রেমিট্যান্স। আরব আমিরাত থেকে ৮৭২ কোটি টাকা এবং কুয়েত থেকে ৩২০ কোটি টাকা সমমূল্যের রেমিট্যান্স কম এসেছে আগের বছরের চেয়ে। এর বাইরে বাহরাইন থেকে ৫৯২ কোটি টাকা, লিবিয়া থেকে ২৬৪ কোটি টাকা এবং ওমান থেকে ৩২ কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশীক মুদ্রা কম এসেছে।

আট দেশের মধ্যে প্রধান ছয়টি দেশ থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯০৭ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার, যা সমাপ্ত অর্থবছরে কমে নেমেছে ৮৫৫ কোটি ডলারে।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, মূলত দুটি কারণে মাধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো তেলের দাম কমে যাওয়া। জ্বালানি তেলনির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে তেলের দাম কমে যাওয়ায় ওই সব দেশে উন্নয়ন ব্যয় ব্যাপক হারে কমে গেছে। অর্থনৈতিক সঙ্কটে উন্নয়নমূলক কাজকর্মও কমে গেছে। উন্নয়ন ব্যয় কমে যাওয়ায় তাদের শ্রমিকের চাহিদা কমে গেছে। যেহেতু বাংলাদেশের বেশির ভাগ প্রবাসীই অদক্ষ, ফলে মধ্যপ্রাচ্যের উন্নয়ন ব্যয় কমে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব পড়েছে আমাদের রেমিট্যান্সের উপর। তারা আগের মতো আর শ্রমিক নিচ্ছে না; বরং যারা আছে তাদেরকেও অনেক ক্ষেত্রে ফেরত আসতে হচ্ছে।

দ্বিতীয় কারণ হলো, ডলারের দাম কমে যাওয়া। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে ডলারের দাম কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসী ও রপ্তানিকারকদের কথা ভেবে বাজার থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কিনছে। ফলে দেশের বৈদেশীক মুদ্রাবাজার অনেক ক্ষেত্রেই স্থিতিশীল রয়েছে। অর্থাৎ ডলারের দাম না কমলেও বাড়েনি। কিন্তু মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে প্রকৃতপক্ষে ডলারের মূল্য কমে গেছে। ফলে এর প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের উপর। এর বাইরে কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে হারে শ্রমিক ফিরে আসছে সে তুলনায় যাচ্ছে না, বরং ক্ষেত্র বেশির ভাগ দেশে বৈধভাবে শ্রমিক নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সব মিলে রেমিট্যান্সের উপর প্রভাব পড়েছে।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে হবে। একই সাথে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো বাড়াতে হবে। এজন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে; অন্যথায় রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে বৈদেশীক মুদ্রার উপর চাপ বেড়ে যাবে।