মালিবাগ–মগবাজার যেন পরিত্যাক্ত কোন সড়ক, নেই সংস্কারের কোন আলামত

ঢাকা: যুদ্ধপরবর্তী অনেক অঞ্চল ‘পরিত্যাক্ত’ বা ‘উপদ্রুত’ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজধানী ঢাকার কোনো অঞ্চলকে সে রকম ঘোষণা না দেওয়া হলেও রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ২ নং গেট থেকে মালিবাগ, শান্তিবাগ, মৌচাক, মগবাজার এলাকার সড়ক কার্যত ‘পরিত্যক্ত’ ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। এসব এলাকায় বসবাসকারী কিংবা এই রুটে যাতায়াতকারী হাজার হাজার মানুষ নিরবে নিভৃতে সীমাহীন কষ্ট ভোগ করে চলেছে দিনের পর দিন, যেন দেখার কেউ নেই।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ২নং গেট থেকে মালিবাগ মোড়, শান্তিবাগ ওদিকে মৌচাক, মগবাজার সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্র ফ্লাইওভারের কর্মযজ্ঞের নামে ধ্বংসযজ্ঞ, সরঞ্জামের জঞ্জাল, বিশাল বিশাল খাদ ও বিশৃঙ্খলা। উড়ালসড়কের পিলার নির্মাণের কাজ শেষ হলেও রাস্তায় পড়ে আছে নির্মাণসামগ্রী, তার মধ্যেই তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল স্ল্যাব; কোথাও রাস্তার এক পাশ বন্ধ করে, কোথাও দুই পাশে সরু গলির মতো জায়গা রেখে। রাস্তার ওপর ও দুই পাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। কোথাও খানাখন্দে ভরা, কোথাও কাটাকাটি চলছে। আর এসবের মাঝেই চলছে বাস-মিনিবাস-অটো, রিকশাসহ বিভিন্ন প্রকার যানবাহন। কয়েক মিনিটের পথ চলতে ঘণ্টা পার হয়ে যায়। তারপরও বিকল্প না থাকায় এ রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষকে চলাচল করতে হয়। বৃষ্টি হলে এসব এলাকার রূপ বদলে হয়ে যায় সেচকৃত পুকুরের মতো। একটু বৃষ্টি হলেই গর্তে পড়ে রিক্সা-ভ্যান উল্টে যাচ্ছে। ঘটছে দুর্ঘটনা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে হেঁটে চলাও মুশকিল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে ছোট্ট ডোবা অথবা সেচকৃত কোন পুকুর।

মালিবাগ সড়ক
ছবি: শান্তিনগর থেকে মালিবাগ মোড়ের রাস্তা

সামনে প্বিত্র ঈদ-উল-ফিতর। গত দুই বছরে চারটি ঈদ সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে পার করেছেন এসব এলাকার মানুষ। প্রতিবার মন্ত্রীরা আসেন, হম্বিতম্বি করে গরম গরম নির্দেশ দিয়ে চলে যান। এভাবে অনেকে আসেন, যান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়না। ১৪ জুন সেতু ও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান এলেন। এরপর এলেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও। সবাইকে আশ্বাস দিলেন, রাস্তা ঠিক হয়ে যাবে। হয়নি। ঈদের আগে ঠিক হওয়ার কোনো লক্ষণও নেই। মৌচাক থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত কয়েকটি সুপার মার্কেট ছাড়াও আছে সারি সারি দোকান। দোকানিরা বসে আছেন হতাশা নিয়ে। মৌচাক মোড়ে মেডিসিন কর্নারের স্বত্বাধিকারী বলেন, বেচাকেনা ৩০ শতাংশে নেমে গেছে। অনেক দোকানে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন।

এ সড়কেই রয়েছে ঢাকা কমিউনিটি কলেজ ও হাসপাতাল, সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, রাশমনো পলি ক্লিনিক, আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। আছে ভিকারুননিসা স্কুল ও কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ, নজরুল বিদ্যালয়, ইস্কাটন গার্লস স্কুল, ইস্পাহানী স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। হাসপাতালে যেতে যেতে চিকিৎসক-রোগী কিংবা বিদ্যালয়ে যেতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা নিত্য দুর্ভোগ পোহালেও দেখার কেউ নেই।

বিএনপি সরকার ২০০৪ সালে নগরের যানজট নিরসন তথা নগরবাসীর চলাচলের সুবিধার জন্য মগবাজার-মৌচাক সমন্বিত উড়ালসড়ক প্রকল্পটি হাতে নেয়। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর একনেকের বৈঠকে এটি অনুমোদন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়ালসড়কের শিলান্যাস করেন। তখন বলা হয়েছিল, দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে। কিন্তু তিন বছর পর এসে ২০১৬ সালের জুনে কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, কাজ শেষ হতে আরও এক বছর লাগবে। একটি উড়ালসড়ক নির্মাণ করতে পাঁচ বছর!

অনেক দেশে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অবকাঠামোগত কাজ শেষ করতে না পারলে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়। আর এখানে উন্নয়নের আক্বেল সেলামী দিতে হয় জনগণকে।

ফ্লাইওভার-মালিবাগ
ছবি: মালিবাগ মোড়ের রাস্তার চিরাচরিত রূপ

প্রকল্পের কাজে বিলম্ব প্রশ্নের জবাবে প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলজিইডির একজন কর্মকর্তা বললেন, উড়ালসড়কের মতো বড় প্রকল্প করার অভিজ্ঞ লোকবল আমাদের নেই। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিতে হয়। কাজও নেওয়া হয়েছে বিদেশি কোম্পানির নামে। ২০০৪ সালে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১১ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। তৃতীয় ধাপে খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণব্যয়ও বাড়ছে।

মগবাজার-মৌচাক এলাকার জনদুর্ভোগের দায় কেউ নিতে চাইছে না। সিটি করপোরেশন বলছে, প্রকল্পটি এলজিইডির। অতএব, সড়ক ঠিক রাখার দায়িত্বও তাদের। এলজিইডির জবাব, কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্মাতা প্রতিষ্ঠানেরই রাস্তা ঠিক রাখার কথা। আর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের উত্তর হলো, কাজ শেষ না করে কার্পেটিং করলে কাজে আসবে না। এই পাল্টাপাল্টিতে এলাকাবাসীর জীবন ওষ্ঠাগত।