বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার নামে খ্রিস্টান মিশনারি সার্জনের ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের তথ্য

missionary donn ketcham scandal

ডেস্ক: সাবেক মিশনারি সার্জন ডন কেচাম বাংলাদেশে প্রায় ২০ জন শিশু ও ৪ জন নারীকে যৌন নির্যাতন করেছে। তার হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুদের অনেকে তারই সহ-মিশনারিদের সন্তান। ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ অপকর্ম করেছে সে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রফেশনাল ইনভেস্টিগেটরস ইন্টারন্যাশনালের (পিআইআই) তদন্তে এসব বেরিয়ে এসেছে।

এ খবর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রিশ্চিয়ান ম্যাগাজিন ওয়ার্ল্ড ম্যাগ। ২৮০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে এসব ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেছে এসোসিয়েশন অব ব্যাপ্টিস্টস ফর ওয়ার্ল এভাঞ্জেলিজমের (এবিডব্লিউই) নেতারা।

এ নির্যাতনের অভিযোগ অত গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। সার্জন কেচামের অপরাধের আংশিক তালিকা তৈরি করা হয় ওই প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক বিয়ে-বহির্ভূত সমপর্ক, স্বাস্থ্যসেবার অজুহাতে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ ও ভিকটিমদের ওপর মাদক প্রয়োগ করা।

১৯৭৩ সালে প্রথম নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে ঊর্ধ্বতনদের জানান কেচামের এক সহকর্মী। পিআইআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রুপের নীতি অনুযায়ী কেচামকে তখনই পদ থেকে বহিষ্কার করা উচিত ছিল এবিডব্লিউই’র। তাহলে পরবর্তীতে অনেক ভিকটিমকে তার নির্যাতনের শিকার হতে হতো না। অথচ, এবিডব্লিউই’র তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওয়েন্ডেল কেমপটনের সঙ্গে তিনটি কথোপকথন শেষে, ক’দিন পরই কাজে পুনরায় যোগদান করেন কেচাম। তার সঙ্গে যে মিশনারি নারীর সমপর্ক ছিল, তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

পিআইআই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ফিরেই ডন কেচাম বহু তরুণীকে স্বাস্থ্যসেবার নাম করে যৌন নির্যাতন করেন। ১৯৮৪ সালে, তার আরেকটি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে এবিডব্লিউই নেতারা ‘হঠকারী ঘটনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। জড়িত মিশনারি নার্সকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কেচামকে কোনো শাস্তি দেয়ার বদলে, বাংলাদেশেরই আরেকটি মিশনারি চালিত হাসপাতালে বদলি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত যাওয়ার পর, কেচামকে ৩০টি কাউন্সেলিং সেশনে বসতে বলে এবিডব্লিউই। এদের মধ্যে মাত্র ১৭টিতে অংশ নেয় সে। এরপর আবারও তাকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়!

বাংলাদেশে আবার এসে, কেচাম তার এক সহকর্মী মিশনারি দম্পতির ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে নির্যাতন শুরু করেন। প্রায় ছয় মাস ধরে ওই শিশু বেশ কয়েকটি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ১৯৮৯ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত গেলে, ওই মেয়ে তার পাস্তুরের কাছে এ যৌন হয়রানির কথা প্রকাশ করে। এরপর এবিডব্লিউই কেচামকে বহিষ্কার করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির নেতারা ‘জোরদারভাবে উৎসাহ’ দেন যে, ওই ভিকটিম মেয়ে যাতে একটি স্বীকারোক্তিতে স্বাক্ষর করে যে, সে ‘ডা. ডনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয়েছে যা ঈশ্বরের কাছে সন্তুষ্টিজনক ছিল না’। এবিডব্লিউ কর্মকর্তারা ওই শিশু ভিকটিমকে ‘স্বপ্রণোদিত পার্টনার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন! এ স্বীকারোক্তির কথা শুনে ভিকটিমের মা-বাবা রেগে যান। রিলিজিয়ন নিউজ সার্ভিসকে ওই কিশোরীর পরিবার জানায়, ‘এবিডব্লিউই নেতৃত্ব বারবার কেচামকে ফিল্ড থেকে সরাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে আমরা ভেঙে পড়ছি। আমাদের মেয়ে আজ পর্যন্ত যে অপরিমেয় কষ্ট ভোগ করছে, আমাদের ইচ্ছা এই নেতারা তা বুঝুক।’

পিআইআই রিপোর্টে বলা হয়, ১৩ বছর বয়সী শিশু ও তার পরিবারের বদলে তখন ৫৮ বছর বয়সী শিশু যৌন নিপীড়নকারী ডন কেচামের প্রতি অধিক মনোযোগ, যত্ন ও সমর্থন প্রকাশ করে এবিডব্লিউই। এছাড়া এ বিষয়টি বাংলাদেশ বা যুক্তরাষ্ট্রের আইনি কর্তৃপক্ষের কাছে জানায়নি তারা। এবিডব্লিউই কেচামকে বহিষ্কার করলেও, গ্রান্ড র‌্যাপিডস ও মিখে ডাক্তারি চালিয়ে যায় সে।

২০০২ সালে কেচামের যৌন নির্যাতনের শিকার সাতজন এবিডব্লিউই’র তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাইকেল লফটিসের মুখোমুখি হয়। তারা জানান, কেচামের নির্যাতনের শিকার হওয়া আরো অনেক ভিকটিম রয়েছেন। লফটিস তাদেরকে এ ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর তদন্ত শুরু করেন। নয় বছর পরও ওই তদন্ত শেষ হয়নি!

২০১১ সালের মার্চে, ক্ষুব্ধ ভিকটিমরা একটি ব্লগ ও ‘বাংলাদেশ এমকেএস সিপক’ নামে একটি ফেসবুক পেজ চালু করেন। এর উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ‘পূর্বে যা অন্ধকারে রাখা হয়েছিল তার দিকে আলো ফেরানো, প্রকাশ্যে সাবেক এবিডব্লিউই মিশনারি ডা. ডন কেচামকে শিশু যৌন নির্যাতনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা ও তার অপরাধ ধামাচাপা দিতে এবিডব্লিউ’র প্রচেষ্টা নথিভুক্ত করা’।

দুই মাস পরে এবিডব্লিউই বোর্ড গ্রেস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে তদন্তের জন্য নিয়োগ দেয় ও প্রেসিডেন্ট লফটিসকে বহিষ্কার করে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেচাম তার ডাক্তারির সনদ জমা দেয়। দুই বছরের তদন্ত শেষে, পরের বছর এবিডব্লিউ তাদেরই নিয়োগ করা গ্রেসকে বহিষ্কার করে। কারণ, তাদের ‘প্রচুর তদন্তমূলক ত্রুটি’ রয়েছে। এর পরিবর্তে পিআইআই’কে নিয়োগ দেয়া হয়।

তাদের অর্থায়নের বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশও করা হয়। কিন্তু কেচাম ও তার পরিবার পিআইআই’র সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানায়।
অবশেষে প্রতিবেদন বের করেছে পিআইআই। প্রতিবেদন প্রকাশের পর, এবিডব্লিউ জানায়, যারা কেচামের অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার জন্য দায়ী তাদের সবাইকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া নেতাদের জন্য নতুন নীতিমালা ও প্রশিক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।

এবিডব্লিউই’র অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আল কোকরেল বলেন, ‘এই নির্যাতনের ফলে যে ভোগান্তি ও যন্ত্রণা তৈরি হয়েছে, তা প্রলেপ দিতে কোনো অনুশোচনা, পরিতাপ বা লজ্জা যথেষ্ট নয়। ডন কেচাম যা করেছে, তা নিন্দনীয়। এবিডব্লিউ’র পর্যালোচনা ও পদক্ষেপের অভাব হলো স্রেফ ক্ষমার অযোগ্য।’ তবে এবিডব্লিউ কর্মীদের এ ধরনের কোনো বিষয় বা সন্দেহজনক তৎপরতা মিশনারির হোম অফিসে জানাতে বলা হয়েছে, পুলিশকে নয়।

তবে ওই ব্লগে যেসব ভিকটিমরা কথা বলছেন, তারা এখনও সন্দেহের মধ্যে আছেন। শ্যারি ক্রোকার হবার নামে একজন লিখেছেন, এ রিপোর্ট আসার পর, আমি আবারও হতাশ। এবিডব্লিউই আসলে বিষয়টা ধরতে পারছে না। এ ধরনের নির্যাতনের কথা অবশ্যই সরকারি কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে, মিশনের কাছে নয়! প্রত্যেক মিশনেরই বাইরের নজরদারি প্রয়োজন যাতে করে তারা স্বচ্ছ ও সৎ থাকতে পারে। মিশনকে ভালো দেখানোর জন্য চুপ থাকার বোঝা কেন বইবে শিশুরা?’

আরো তথ্য: খ্রিস্টিয়ানিটি টুডে