শিক্ষক-লেখকদের চৌর্যবৃত্তির সমালোচনা তুঙ্গে, ছাড় পাচ্ছেন না জাফর ইকবালও

ডেস্ক: বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। শিক্ষকদের নারী কেলেংকারি, শিক্ষক নিয়োগ কেলেংকারি, প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেংকারি, ভর্তি পরীক্ষা কেলেংকারি ও গবেষণার জন্য বরাদ্দ টাকা কেলেংকারি সহ নানান কেলেংকারির ঘটনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে।

তবে, অতীতের সব কেলেংকারিকে ছাপিয়ে গেছে সর্বশেষ সংঘটিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সামিয়া রহমানসহ আরও কয়েকজনের অন্যের গবেষণা চুরির কেলেংকারির ঘটনা। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠা ঝড় দেখে মনে হচ্ছে সাংবাদিক সামিয়া রহমানের গবেষণা চুরির ঘটনার নীচে আরও বড় ইস্যুগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। শিক্ষাঙ্গন ও মিডিয়া পাড়া থেকে শুরু করে সবখানেই এখন আলোচনার বিষয় সামিয়া রহমানের গবেষণা চুরির ঘটনা।

গবেষণা পত্রে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে৷ তবে এই ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়৷ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন মনে করে এ ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানো ছাড়া উপায়্ নেই৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ যে পাঁচজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে, তাঁরা হলেন, সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান, ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজান এবং ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক রুহুল আমিন, নুসরাত জাহান ও বদরুজ্জামান ভূঁইয়া৷

সামিয়া রহমান ও মাহফুজুল হক মারজানের একটি যৌথ লেখা গত বছরের ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ‘সায়েন্স রিভিউ’ নামে একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়৷ শিরোনাম ‘এ নিউ ডাইমেনশন অফ কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার: এ কেস স্ট্যাডি অফ দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’৷

অভিযোগ, তাঁরা মিশেল ফুকো’র ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি আর্টিকেল থেকে হুবহু কপি করেছেন কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই৷ ১৯৮২ সালের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’র ৪ নম্বর ভলিউমের ১৯ নং পৃষ্ঠায় ফুকোর এই আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয়েছিল৷ অভিযোগ রয়েছে তাঁদের দু’জনের গবেষণাপত্রের ৬১ ভাগই নকল৷

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপশি বিভিন্ন গণমাধ্যমেও কাজ করছেন সামিয়া রহমান। বেসরকারি একটি চ্যানেলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানও পরিচালনা করেন সামিয়া রহমান। সামিয়া রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হলেও তাকে কেউ চিনতো না। মুজাম্মেল বাবুর একাত্তর টিভি চালু হওয়ার পরই মানুষ তার নাম জানে। আর সামিয়া রহমানকে একজন বিতর্কিত সাংবাদিক হিসেবেই জানে মানুষ। গবেষণা চুরিতে ধরা খাওয়ার পর তার আসল চেহেরা বেরিয়ে এসেছে। আরেকজনের লেখা চুরির অভিযোগে গণমাধ্যম অঙ্গন থেকে তাকে বহিস্কার করারও দাবি উঠেছে।

অন্যদিকে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তিন শিক্ষক একইভাবে অন্যের লেখা তাঁদের গবেষণাপত্রে নিজেদের লেখা বলে চালিয়ে দিয়েছেন৷

সামিয়া রহমান গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, ‘‘আমি ওই আর্টিকেল লিখিনি৷ মারজান (মাহফুজুল হক মারজান)-এর সঙ্গে আমি একটা লেখার আইডিয়া শেয়ার করেছিলাম৷ পরে সে আমার সঙ্গে আর কথা না বলেই সেই লেখা আমার ও তার নামে জার্নালে ছাপিয়েছে৷ এখন তদন্ত হচ্ছে৷ তদন্তের পর আমি বিস্তারিত বলব৷ আমি এই ঘটনায় কোনোভাবেই জড়িত না৷”

অন্যদিকে মাহফুজুল হক মারজান বলেন, ‘‘আমরা দু’জন মিলেই আর্টিকেলটি লিখেছি৷ সামিয়া রহমানের অ্যাকটিভ অংশগ্রহণ ছিল৷ আর আমাদের অপরাধ কী হয়েছে তা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ হলেই জানা যাবে৷ আমি কমিটির কাছে আমার বক্তব্য দিয়েছি৷ এখন আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না৷’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে৷ তবে সবাই শাস্তির আওতায় আসেননি৷ গবেষণাপত্রে চৌর্যবৃত্তির দায়ে ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আ জ ম কুতুবুল ইসলাম নোমানীকে পদাবনতি দিয়ে সহকারি অধ্যাপক করা হয়৷

পিএইচডি থিসিসে জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূর উদ্দিন আলোকে চাকরিচ্যুত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ৷

গবেষণা জালিয়াতি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের আরেকজন শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিক-এর বিরুদ্ধে সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ আছে৷

এছাড়া সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সালমা বেগমের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠে এক বছর আগে৷

বর্তমানে যে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে, সেই তদন্ত কমিটির একজন সদস্য হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল৷ তিনি গণমাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘তদন্ত শেষ হওয়ার আগে ওই পাঁচজনের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না৷ তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়৷ আগেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে৷ অভিযোগ পাওয়ার ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেই৷ কিন্তু এখন পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে একটি নীতিমালা করা প্রয়োজন৷ আর তাতে এই ধরণের কোনো অপরাধে কী শাস্তি হবে তা সুনির্দষ্ট করে দেয়া প্রয়োজন৷ কারণ, অতীতে দেখা গেছে, একই অপরাধে ভিন্ন শাস্তি হয়েছে৷”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমাদের কাছে ঠিক হিসাব নাই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন শিক্ষক এ পর্যন্ত এই ধরনের চৗর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত হয়েছেন৷ আমাদের একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে৷ কমিটির কাছে অভিযোগ দেয়া যায়৷ অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেই৷”

শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একই অবস্থা বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুরী কমিশন ( ইউজিসি)৷ এমনকি ইউজিসির অর্থায়নে নানা গবেষণা এবং জার্নালেও চৌর্যবৃত্তির ঘটনা ধরা পড়েছে।

ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘এ ধরনের ঘটনা এখন সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটছে৷ আমাদের এ ব্যাপরে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো এখতিয়ার নাই৷ তবে আমাদের অর্থায়নে যেসব গবেষণা হয়, জার্নাল প্রকাশ হয়, সেখানে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি৷ আমরা অনেক চৌর্যবৃত্তির ঘটনা ধরেছি এবং লেখা প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি৷ কিন্তু কিছু ব্যবস্থা নেয়া হলেও সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷”

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের কলুষমুক্ত রাখার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মর্যাদার প্রশ্ন৷ এসব ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া ঠিক না৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে৷”

অনেকে আবার বলছেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জাফর ইকবালের শিষ্য হলেন সামিয়া রহমান। জাফর ইকবালই প্রথম বিদেশি লেখকদের বই অনুবাদ করে নিজের নামে ছাপিয়ে বিজ্ঞান লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। আর সামিয়া রহমান যেহেতু জাফর ইকবালের একান্ত শিষ্য, তাই তার পক্ষেও অন্যের লেখা চুরি করে নিজের নামে ছাপানো সম্ভব। জাফর ইকবাল ও সামিয়া রহমানরা একই নীতি আদর্শের লোক।

অপরদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাফর ইকবাল বিদেশি কাহিনীর অনুকরনে, ছায়া অবলম্বনে বই লিখে নিজের নামে চালিয়ে দিয়ে আসছেন বহুদিন ধরে। কিন্তু, বইয়ের কোথাও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেননা তিনি।

যেমন জাফর ইকবালের চুরি করা কয়েকটি বই হলো-

আসল- অ্যালিয়েন (১৯৭৯): জাফর ইকবাল নাম দিয়েছেন ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম (১৯৮৮)।

আসল- পিচ ব্ল্যাক (২০০০): জাফর ইকবাল নাম দিয়েছেন অবনীল (২০০৪)।

আসল- ম্যাটিল্ডা (১৯৮৮, বই) (১৯৯৬, চলচ্চিত্র): জাফর ইকবাল নাম দিয়েছেন নিতু আর তার বন্ধুরা (১৯৯৯)।

আসল- বেবি’জ ডে আউট (১৯৯৪)। জাফর ইকবাল নাম দিয়েছেন মেকু কাহিনী (২০০০)।

আসল- আ চাইল্ড কলড “ইট” (১৯৯৫) : জাফর ইকবাল নাম দিয়েছেন আমি তপু (২০০৫)।

এভাবে জাফর ইকবাল বিদেশি লেখকদের লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক, গল্প, নাটক, সিনেমার কাহিনী সহ বিভিন্ন বই বাংলা অনুবাদ করে তার নিজের নামে ছাপিয়েছেন।