বছরে সিজারে ভূমিষ্ট হচ্ছে ৬ লাখ শিশু, বাড়ছে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি

ঢাকা: দেশে অনেক নারীর নিজ ও পরিবারের সদস্যেদের ইচ্ছায়, কেউবা চিকিৎসকের কথায় বিশ্বাস করে বা প্ররোচনায় পড়ে সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু প্রসব করছেন। সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্ম বাড়ছে। এতে শীর্ষে রয়েছেন শিক্ষিত ধনী শ্রেণির যুবতীরা। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরে ৬ লাখের বেশি শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হয়।

‘মাতৃমৃত্যু ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবা জরিপ ২০১০’ চিত্রে দেখা যায়, ২০০৯-এ দেশে চার লাখের বেশি শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল। ২০০১ সালের তুলনায় এই সংখ্যা পাঁচ থেকে ৬ গুণ বেশি। দেশে শিশু জন্মের সংখ্যা ও হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারও বেশি হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে সেবা গ্রহণকারী পক্ষকে বিপুল অর্থ অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে মা ও শিশুর  বাড়ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার দরকার হয়। মায়ের অপুষ্টি ও গর্ভকালীন সমস্যার কারণে প্রসবে জটিলতা দেখা দেয়। মা ও নবজাতকের প্রাণ ও স্বাস্থ্যরক্ষায় অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সিজারিয়ানে শিশু জন্ম বাড়ছে।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)-২০১৪-এর তথ্য মতে, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের বাড়ার গতি ২০০৪ সালে ছিল ৪ শতাংশ, ২০০৭ সালে ছিল ৯ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ১৭ শতাংশ আর ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশ। এতে ৮ শতাংশ অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হচ্ছে। এক কর্মশালা সেভ দ্য চিলড্রেনের হেলথ নিউট্রেশন অ্যান্ড এইচআইভি/এইডস বিভাগের পরিচালক ডা. ইশতিয়াক মান্নান এই প্রসঙ্গে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষিত ও ধনিক শ্রেণির মধ্যে অস্ত্রোপচারের হার বেশি। দরিদ্র পরিবারে ৭ শতাংশ সিজারিয়ান করান।

সরকারি হাসপাতালে ৩৪ শতাংশ, ৮০ শতাংশ লাভজনক প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে, ২৪ শতাংশ এনজিও প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমের শিশু জন্ম দিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টারা জানান, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে বাচ্চা প্রসব করলে হাসপাতালের আয় হয় অতিরিক্ত টাকা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়ী মনোভাব আর ডাক্তারদের যথেষ্ট সময় না দেয়াই এর অন্যতম কারণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্র জানায়, গেল বছর এইখানে নতুন শিশুর জন্ম হয়েছে ১২ থেকে ১৩ হাজার। এর মধ্যে সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে ৫০ শতাংশ নারীর।

দেশে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম হওয়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সরকারি জরিপেও এ তথ্যটি উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে যে সংখ্যক নবজাতক জন্ম হচ্ছে এর ৩৫ শতাংশই অপ্রয়োজনীয়। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি একশ নবজাতকের মধ্যে ২৩ জনেরই জন্ম হচ্ছে সিজারের মাধ্যমে। অথচ সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম হওয়ার পর মা ও সন্তান দু’জনই যে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে- সেই বিষয়টি জানানো হচ্ছে না।

দেশের প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সন্তান প্রসবের জন্য ভর্তি হয়েছিলো এক লাখ ৬৬ হাজার ৭২১ জন প্রসূতি। তাদের মধ্যে এক লাখ ১৭ হাজার ১৬৪ জনের সিজার করে সন্তান হয়েছে। আর মাত্র ৪৭ হাজার ৮৬৮ জনের হয়েছে নরমাল ডেলিভারি। ২০১৩ সালের সরকারি তথ্যে এমন চিত্র উঠে এসেছে। অর্থাৎ তখন সিজারিয়ানের হার ৭০ শতাংশ থাকলেও চলতি ২০১৫ সালে এ হার প্রায় ৮০ শতাংশে উঠে গেছে বলে জানিয়েছে প্রসূতিসেবা বিশেষজ্ঞরা।

গবেষণায় দেখা গেছে- প্রকৃতপক্ষে ১০০ সিজারিয়ান প্রসূতির মধ্যে ১৫ থেকে ২০ ভাগেরও সিজারের দরকার ছিল না। ৮০ ভাগেরই নরমাল ডেলিভারি করা যেত। কিন্তু একটি মহলের প্রচারণার কারণে ক্ষতিকর এ পথটিই অনুসরণ করা হয়েছে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে।

বিশেষজ্ঞরা বলছে, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে ডেলিভারি করার সময় মাকে যেসব অ্যানেস্থেটিক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, তা নবজাতকের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। সফল বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারেও বাধা হয়ে উঠতে পারে। সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া নবজাতক শিশুর হাসপাতালে থাকার সময়কাল বেশি বলে তাদের ইনফেকশন ঝুঁঁকি থাকে। ওই সব শিশুর ব্লাড ইনফেকশনের হার বেশি। সিজার করায় ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সময়ের দুই-তিন সপ্তাহ আগেই সন্তান হয়ে যায়। শিশু ইনফেকশনে পড়ার এটিও একটি কারণ। যেসব মা সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান হওয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী থাকে, সেসব নবজাতকের প্রথম ২৮ দিনে মৃত্যুহার তিনগুণ বেশি থাকে।

নিউরোসায়েন্সের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে পেয়েছে, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া শিশু পরবর্তী সময়ে সিজোফ্রেনিয়ার মতো গুরুতর মানসিক রোগে ভোগার ঝুঁকিতে থাকে বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো দেশের মোট জন্মগ্রহণকারী শিশুর মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ থেকে ১৫ ভাগের বেশি সিজারিয়ান পদ্ধতিতে ভূমিষ্ঠ হওয়া মোটেও কাম্য নয়। সংস্থাটি বলছে, সন্তানধারণের সময় নানা কারণে (প্রসূতির পুষ্টি পরিস্থিতি, স্থূলতা, বয়স) জটিলতা দেখা দিতে পারে। একশ’র মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ জনের জটিলতা দেখা দেয়। তখন স্বাভাবিক প্রসব নাও হতে পারে, হলেও নবজাতক বা মায়ের জীবনের ঝুঁকি দেখা দেয়। এসব ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার তথা সিজারের প্রয়োজন হয়।