আরাকানে জ্বলছে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি : চলছে গণহত্যা ও সম্ভ্রমহরণ

ডেস্ক: মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর বর্মী দস্যুদের নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, চলছে গণহত্যা ও সম্ভ্রমহরণ। হেলিক্প্টার থেকে শত শত রাউন্ড মর্টার ও গুলি বর্ষণও করা হচ্ছে। নিহতদের শোকে বাকরুদ্ধ আত্মীয়স্বজন। চারদিকে কান্নার শব্দ। স্বজনের লাশ পেছনে ফেলে রুদ্ধশ্বাসে পালাচ্ছে মজলুম মানুষ। আবার পালাতে চেষ্টা করা হলে পিছন থেকে করা হচ্ছে গুলি। যারা গোলাগুলির শিকার হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

গত বৃহস্পতিবার থেকেই অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আরো হিংস্র হয়ে উঠেছে। খুন, সম্ভ্রমহরণ, লুণ্ঠন, রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগসহ সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। দিনে রাতে হ্যালিকপ্টার থেকে মর্টার, বোমা হামলা ও মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ শব্দে মুর্ছা যাচ্ছে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা। যালিম হায়েনার পাশবিক যুদ্ধের উন্মদনা চলছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরকানে। উগ্রপন্থী দমনের অজুহাতে বোমা ও মর্টার হামলা করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে মিয়ানমারের হানাদার বাহিনী। ‘সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর’ সদস্য অপবাদ দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আরাকানের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার তরুণদের। আর বাংলাদেশ জিরো পয়েন্টে বাড়ছে রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা।

রোহিঙ্গারা বলছেন, গণহত্যার নতুন অধ্যায় শুরু করেছে সে দেশের সরকারি বাহিনী। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ও রাখাইন (মগ দস্যু) সম্প্রদায়। এইসব বাহিনী এবারে একচেটিয়াভাবে রোহিঙ্গাদেরকে গণহত্যা করে রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে বৌদ্ধদের পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছে। হাজার বছরের রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাসকে ধুলোয় মুছে দিতে বর্বর বৌদ্ধ বর্মী যালিমরা গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী কাজ করছে জাতিসংঘের আহ্বানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে।
ফলে মিয়ানমারের সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর হাত থেকে নির্মম নির্যাতন থেকে বাদ পড়ছে না মায়ের কোলের শিশু। মায়ের কোল থেকে শিশু ছুড়ে ফেলা হচ্ছে জ্বলন্ত আগুনে। পদদলিত করে দুই দিনের শিশু খুন করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না বর্বর বৌদ্ধ বর্মী যালিমরা। নারীর সম্ভ্রমহরণ করছে গণহারে। এসব রোহিঙ্গার বেঁচে থাকার স্বপ্ন দিন দিন ফুরিয়ে আসছে। নির্বিচারে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীর সম্ভ্রমহরণ, লুন্ঠনের শিকার হয়ে জীবন বাঁচাতে সহায় সম্পত্তি ফেলে মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজছে সহায়হীন অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশ সীমান্তের নাফ নদীর পাড়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী ও শিশু জড়ো হয়েছে প্রাণ বাঁচাতে। আকাশের নিচে মাটির বিছানায় অন্ন-বস্ত্রহীন নিরূপায় হয়ে চেয়ে আছে একটু সহায়তা পাওয়ার আশায়।

কোনো মা সন্তান হারিয়ে, কোনো সন্তান মা হারিয়ে আর্তনাদ করছে। মায়ের বুকে দুধ না পেয়ে কোলের শিশু ক্ষণেক্ষণে কেঁদে মাকে বলার চেষ্টা করছে। মায়েরা অসহায় হয়ে পড়েছে। অসহায় হয়ে পড়েছে এইসব নারীদের মাতৃত্ব। বয়োবৃদ্ধরা চোখে মুখে চরম হতাশার চিত্র। তাদের ছেলে, মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের চিন্তায় গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে।

রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়ার উত্তরপাড়ার আহমদ হোসেন মুঠোফোনে জানান, রোববার খুব ভোরে বর্মী বাহিনীর একটি দল গ্রামে ঢুকে স্থানীয় জহির, করিম ও আব্দুর শুক্কুরকে আটক করে নিয়ে যায়। এ সময় তারা পালিয়ে পাশের পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। পরে ওই তিন তরুণের উপর বর্ববর নির্যাতন চালিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় জঙ্গলে ফেলে দেয়া হয়। ঢেঁকিবনিয়া পূর্বপাড়ার আবছার কামাল জানান, সেনাবাহিনী সন্ধ্যার পর বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি শুরু করেছে। যেসব বাড়িতে মানুষ পাচ্ছে না সেসব বাড়ি বোমা মেরে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আর যাকে পাচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

অপরদিকে রাথদং জেলার সোহাগপ্রাং রোহিঙ্গা পল্লীতে নৃশংস হত্যালীলা চালিয়েছে মিয়ানমারের বর্বর সেনাবাহিনী । পুলিশ, লুন্টিং, সেনা ও বিজিপি সম্মিলিতভাবে এ বর্বরতা চালিয়েছে। সোমবার দিবাগত রাতের শেষভাগে এ নৃশংসতা চালিয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। কয়েকশ’ সৈন্য গ্রামটি ঘেরাও করে চিরুণী অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা পুরুষদের আটক করে। আটককৃত পুরুষদের দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে গণহত্যা চালায়। রোহিঙ্গা নারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে গ্রামের একটি স্কুলঘরে গণসম্ভ্রমহরণ করেছে। উঠতি বয়সের কন্যা শিশুও রক্ষা পায়নি পশুবৎ সেনাদের গণসম্ভ্রমহরণ থেকে। অনেকেই সম্ভ্রমহরণে বাধা দেয়ায় তাদেরকে হত্যা করা হয়।
সূত্র আরো জানিয়েছে, হত্যার পর গাড়িতে তুলে অনেক লাশ নিয়ে গেছে। তবে বেশ কিছু লাশ এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এই সময় এই সব রোহিঙ্গা পল্লীতে অগ্নিসংযোগ করে। পুড়ে মরেছে গবাদিপশুও। গ্রামগুলো এখন জনশূন্যে ও নিস্তব্ধ। এরপর আশেপাশের অন্যসব রোহিঙ্গা পল্লী ঘিরে রেখেছে মিয়ানমারের হানাদার সামরিক বাহিনী। ইতোমধ্যে আরাকানের প্রত্যেক মুসলিম পল্লীতে নিধনযজ্ঞ চালানোর জন্য অমুসলিমদের সরিয়ে নিয়েছে বর্মী প্রশাসন। এভাবে বর্ববরতা চলতে থাকলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো আরাকান রোহিঙ্গাশূন্য হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্লেষকরা।
এদিকে টেকনাফের নাফনদীর পানিসীমানা অতিক্রম করার সময় ৪৭৫ রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। রাতে নাফনদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। ফেরত পাঠানো এসব রোহিঙ্গার বেশিরভাগ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। টেকনাফস্থ বিজিবি ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, রাতে পৃথক অভিযানে ৪৭৫ জন রোহিঙ্গাকে পানিসীমানা অতিক্রম করার সময় প্রতিহত করে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়। গত ৫ দিনে ১০১৬ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড।

গত কয়েকদিনে রোহিঙ্গাদের ১০টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে:

মিয়ানমারের রাখাইনে (আরাকান) বর্মী বাহিনীর রোহিঙ্গা বিরোধী আগ্রাসন শুরুর পর গত কয়েকদিনে অন্তত ১০টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। নতুন কিছু স্যাটেলাইট ছবি ও স্থানীয়দের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়ার কথা জানায় মানবাধিকার সংস্থাটি। এর মধ্যেই ত্রাণকর্মীদের বিরুদ্ধে রাখাইনে সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা করার অভিযোগ তুলেছে হানাদার মিয়ানমার সরকার।

রাখাইনে (আরাকান) রোহিঙ্গাদের নির্বিচার গুলি বর্ষণ ও গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি তাদের ঘর-বাড়িও পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। গত জুমুয়াহবার থেকে সোমবার পর্যন্ত পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যটির মংডু, রাথেডংসহ কয়েকটি শহরের অন্তত ১০টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয় বলে তথ্য পেয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবি বিশ্লেষণ ও গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি।

এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরেও রাখাইনে (আরাকানে) রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বেশ কয়েকটি গ্রামের ১৫ শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার খবর প্রকাশিত হয়। যদিও দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে এসব তথ্য অস্বীকার করা হয়। গত ২৫শে আগস্ট-২০১৭ রাখাইনে (আরাকান) পুলিশ পোস্টে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের হামলার পর বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়ন নতুন কের শুরু হয়। দিন দিন তা বেড়ে চলার প্রেক্ষাপটে ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিক্বিদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা।

এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘অত্যাচারের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন সইতে না পেরে ভিটে-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। তারা নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। আমাদের শিশুদেরও হত্যা করা হচ্ছে। কোনো কারণ ছাড়াই ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে।’ আরেক জন বলেন, ‘আমরা আমাদের ঘর-বাড়িতে বসবাস করতে পারছি না। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আমাদের জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।’