পবিত্র ১১ই রবিউস সানি শরিফ দিনটি উম্মাহর জন্য রহমত, বরকত লাভের মহান দিন

আজ আরবি হিজরি সনের রবীউস সানি মাসের ১১ই তারিখ। দিনটি উম্মাহর জন্য মহান আল্লাহ পাকের রহমত লাভের দিন। কারণ এ দিনটি গউছুল আযম, সাইয়্যিদুল আউলিয়া, আওলাদে রসূল, বড়পীর হযরত শায়েখ সাইয়্যিদ মুহিউদ্দীন আব্দুল ক্বাদির জিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিছাল দিবস। হিজরি ৫৬১ সনের ১১ রবিউস সানি তিনি পরলোকগমন করেন।
‘ইয়াজদাহাম’ ফারসি শব্দ, যার অর্থ এগারো। ফাতিহা-ই-ইয়াজদাহাম বলতে এগারো-এর ফাতিহা শরিফকে বোঝায়।

দিনটি মুসলিম বিশ্ব অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকে। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্ম প্রচারক এবং অলি হজরত আবদুল কাদের জিলানির রহমতুল্লাহি আলাইহি। মোসলমানদের ধর্মীয় জীবনে তার প্রভাব অপরিসীম।

পৃথিবীতে আল্লাহ প্রেরিত নবী-রাসুল এসেছেন ১ লাখ বা ২ লাখ ২৪ হাজার। অন্যদিকে কামেল পীর, অলি, দরবেশ, ফকির এসেছেন অসংখ্য। অনেকে কথাই আমরা জানি না। কারণ তারা ছিলেন নিভৃতচারী।

মহানবি হুযূর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিছালের প্রায় ৫০০ বছর পর বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানির রহমতুল্লাহি আলাইহির জন্ম। তখন ইসলাম ধর্ম এক নাজুক অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোরআন ও রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনার আদর্শ ভুলে মানুষ বিপথে পা বাড়িয়েছিল, ঠিক এমন সময় বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানির রহমতুল্লাহি আলাইহি ইসলামের পথে মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন।

জন্ম ও শৈশব
ইসলামি জগতের প্রাতঃস্মরণীয় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, দরবেশকুল শিরোমনি, বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানির রহমতুল্লাহি আলাইহি ১লা রমজান হিজরি ৪৭০ বা ৪৭১ সালে পারস্যের (বর্তমানে ইরান) এক বিখ্যাত জনপদ ‘জিলান’ এ জন্মগ্রহণ করেন। তার বংশতালিকায় পিতা সাইয়্যিদ শায়খ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত রহমতুল্লাহি আলাইহি এর একাদশতম উর্ধ্বতন পুরুষ হযরত ইমাম হাসান আলাইহস সালাম এবং তার মাতা সাইয়েদেনা ফাতেমা রহমতুল্লাহি আলাইহা এর চৌদ্দতম উর্ধ্বতন পুর্বপুরুষ ছিলেন নবী দৌহিত্র্য হযরত ইমাম হোসেইন আলাহহিস সালাম। এভাবেই তিনি পিতৃ সূত্রে হাসানি ও মাতৃ সূত্রে হোসাইনি বংশধারার উত্তরসূরি। বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানির রহমতুল্লাহি আলাইহি বাবা সাইয়্যেদ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত রহমতুল্লাহি আলাইহি একজন পুণ্যবান, কামেল ও বুজর্গ ব্যক্তি ছিলেন।

তার সম্পর্কে বহুশ্রুত একটি কাহিনি রয়েছে। তখনো তিনি বিয়ে করেননি। একদিন নদীর ধারে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন একটি আপেল পানিতে ভেসে যাচ্ছে। তিনি ফলটি তুলে নিয়ে পরম তৃপ্তিসহকারে খেলেন। কিছুক্ষণ মনে প্রশ্ন জাগলো ফলটি খাওয়া কি ঠিক হলো? ফলের মালিকতো তিনি নন! এবার যে করেই হোক মালিকের সন্ধান করতে হবে। তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। স্রোতের বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করলেন এবং একটি আপেল বাগানে গিয়ে থামলেন। বাগানের মালিক সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ সাউমাই রহমাতুল্লাহি আলািইহি। তিনিও একজন খোদাভীরু ধর্মপ্রাণ সাধক। তার কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে ক্ষমা চাইলেন যুবক হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত রহমতুল্লাহি আলাইহি। বিস্মিত হলেন বাগানের মালিক। তিনি পরীক্ষা করার জন্য বললেন, ‘আপেলেরতো অনেক দাম। কী এনেছ তার জন্য?’ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত রহমতুল্লাহি আলাইহি জবাব দিলেন, ‘আমার কাছেতো কোনো টাকাপয়সা নেই। তবে গায়ে খেটে মূল্য পরিশোধ করতে চাই। আপনি যতদিন খুশি খাটিয়ে নিতে পারেন।’ সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ সাউমাই রহমাতুল্লাহি আলািইহি বললেন, ‘তোমাকে পুরো এক বছর বাগানের দেখাশোনার কাজ করতে হবে। উপরন্তু আমি যখন যে কাজের হুকুম দিব তাই করতে হবে।’

কিন্তু সময় শেষ হওয়ার পর নতুন শর্ত যুক্ত করলেন সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ সাউমাই রহমাতুল্লাহি আলািইহি। তিনি বললেন, ‘আমার একটি অন্ধ, বধির ও বোবা কন্যা আছে। তাকে তোমার বিয়ে করতে হবে।’ তাতেও রাজি হলেন হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত রহমতুল্লাহি আলাইহি। বিয়ের পর বাসর ঘরে ঢুকেই তাজ্জব বনে গেলেন। নববধূতো অপরূপা! অন্ধ, বধির বা বোবা কিছুই নন। পরদিন ব্যাখ্যা দিলেন সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ সাউমাই রহমাতুল্লাহি আলািইহি। এই কন্যা কোনদিন ঘরের বাইরে যায়নি, বাইরের কোন লোকের দিকে কখনো চোখ তুলে তাকায়নি এবং তার মুখে কখনও অশ্লীল বাক্য উচ্চারিত হয়নি। তাই তাকে আমি অন্ধ, বধির ও বোবা বলেছিলাম।

এই পুণ্যবতী নারীর নাম সাইয়্যেদেনা উম্মুল খায়ের হযরত ফাতেমা রহমতুল্লাহি আলাইহা। তার গর্ভেই জন্ম নিলেন গাউসুল আজম। হযরত আব্দুল কাদির জিলানি রহমতুল্লাহি আলাইহি বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখনই তিনি পিতৃহীন হন। তার লালন-পালন ও পড়াশোনার দায়িত্ব এসে পড়ে মায়ের উপর। মা চরকায় সুতা কেটে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করেন। মা-ছেলেকে কখনও কখনও অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়।

শিক্ষাজীবন
খুব অল্প বয়সেই হযরত আব্দুল কাদির জিলানি রহমতুল্লাহি আলাইহি মক্তবে যাওয়া শুরু করেন। বাল্যশিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল জ্ঞানবান পিতা ও গুণবতী মাতার মাধ্যমে। বাবা-মার মাধ্যমেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো ঘরেই শেষ করেছিলেন। সর্বপ্রথমেই তিনি কোরআন পাঠ শিক্ষা করেন এবং হাফেজ হন। গৃহশিক্ষার বাইরে তিনি জিলান নগরের স্হানীয় মক্তবেও বিদ্যা শিক্ষা করেন।

তার প্রখর ধীশক্তি, প্রত্যুতপন্নমতিত্ব ও প্রজ্ঞার ফলে বাল্যকালেই তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।

উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ৪৮৮ হিজরিতে যখন প্রথম তিনি বাগদাদ যান তখন তার বয়স মাত্র আঠারো বছর। বাগদাদ গিয়ে শায়খ আবু সাইদ ইবনে মোবারক মাখযুমি হাম্বলি রহমতুল্লাহি আলাইহি, আবুল ওয়াফা আলী ইবনে আকিল এবং আবু মোহাম্ম ইবনে হোসাইন ইবনে মুহাম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহির কাছে ইলমে ফিকহ, শায়েখ আবু গালিব মুহম্মদ ইবনে হাসান বাকিল্লানি রহমতুল্লাহি আলাইহি, শায়খ আবু সাইদ ইবনে আব্দুল করিম ও শায়খ আবুল গানায়েম মুহম্মদ ইবনে আলী ইবনে মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখের কাছে হাদিস শাস্ত্র এবং শায়খ আবু জাকারিয়া তাবরেয়ি রহমতুল্লাহি আলাইহির কাছে সাহিত্যের উচ্চতর পাঠ লাভ করেন। হযরত আব্দুল কাদির জিলানি রহমতুল্লাহি আলাইহির বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানচর্চার গুরু শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমি রহমতুল্লাহি আলাইহির মনে তরুণ এ শিষ্যের যোগ্যতা ও প্রতিভা সম্পর্কে এতই আস্থা তৈরি করলো যে, নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে নিজে অবসর গ্রহণ করেন।

জিলানি এ মাদরাসার উন্নতি ও উৎকর্ষের কাজে আত্ননিয়োগ করেন। হাদিস, তাফসির, ফিকহ ও অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানের শিক্ষাদান নিজেই শুরু করেন। পাশাপাশি ওয়াজ নসিহত ও তাবলিগের কর্মসূচিও চালু করেন। অল্পদিনের মধ্যেই এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং দেশ বিদেশের বিদ্যার্থীরা ছুটে আসতে লাগলো। এ পর্যায়ে মাদরাসার নামকরণও তার সঙ্গেই সম্পৃক্ত হয়ে ‘মাদরাসায়ে কাদেরিয়া’ হয়ে গেল!

হযরত আব্দুল কাদির জিলানি রহমতুল্লাহি আলাইহির রওজার ভেতরের অংশ

 

হযরত আব্দুল কাদির জিলানি রহমতুল্লাহি আলাইহির শিক্ষকতার জীবন ছিল ৫২৫ থেকে ৫৬১ হিজরি পর্যন্ত মোট ৩৬ বছর। তিনি দিনের প্রথম ভাগে তাফসির ও হাদিস, জোহরের পর কোরাআন, আর অন্যান্য সময় ফিকহ, উসুল ইত্যাদি বিষয়ের পাঠদান করতেন।