ইয়াবা আসা বন্ধ হচ্ছে না যে কারণে

ঢাকা: সীমান্তে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা না থাকায় ইয়াবার চালান বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। সর্বশেষ রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত অপরাধ পর্যালোচনা বিষয়ক এক সভায়ও তুলে ধরা হয়েছে এই চিত্র। একইসঙ্গে ইয়াবাসহ মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবার প্রধান উৎস মিয়ানমার। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দুই পারের পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলো বহাল তবিয়তে আছে। ভারতের কিছু অংশ ও থাইল্যান্ড থেকে ইয়াবা আসছে। এই প্রতিবেশী দেশ থেকে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে ইয়াবা। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) বেশিরভাগ সদস্য সরাসরি জড়িত ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে। তাদের সহযোগিতা করে আসছে দুই দেশের পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলো। সমুদ্রপথে ইয়াবা টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, সাবরাং, উখিয়া উপজেলার মনখালী, মহেশখালীর সোনাদিয়া, ঘটিভাঙ্গাসহ পেকুয়া উপজেলার মগনামা ও উজানটিয়া, কুতুবদিয়া ও আনোয়ারা উপজেলার সমুদ্রপথে খালাস করা হয়। বিশেষ করে টেকনাফ উপকূল দিয়ে সবচেয়ে বেশি ঢুকছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক।

মাদক পাচারসহ সব ধরনের চোরাচালান বন্ধে কাজ করছে বিজিবি। বাহিনীর সার্বিক কর্মকা- ও সফলতার বিষয়ে তথ্য জানাতে গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিজিবি’র সদর দফতর পিলখানায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল আবুল হোসেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মাদকসহ সার্বিক চোরাচালান বন্ধে বিজিবি সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।’ ইয়াবার চালান বন্ধ করতে পারছেন না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ জন্য শুধু একটি বাহিনীকে দায়ী করা যাবে না। পরিবার, সমাজ, সামাজিক সংগঠন, সমাজকর্মী; সর্বোপরি সব বাহিনীর কাজ এটা।’

বিজিবি’র ডিজি আবুল হোসেন বলেন, ‘ইয়াবার উৎপাদন কোথায় হয়, সোর্সটা কোথায়, সেটা জানতে হবে। অবশ্যই এটা মিয়ানমারে হয়। অন্যান্য দেশেও হয়। আমাদের দেশে যে হয় না, তাও নয়। মিয়ানমারের এই চরিত্রটা আপনারা বুঝে নেবেন। এই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে তাদের সব সংস্থার সব স্তরের লোক জড়িত। সেখানে সবাই এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়া এই ইয়াবা ব্যবসায়ের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে রোহিঙ্গা জড়িত আছে। ইয়াবা ব্যবসার জন্য মিয়ানমারেরও কিছু রোহিঙ্গা আছে। যাদের দিয়ে তারা এ ব্যবসা করায়।’

এক হাতে তালি বাজবে না উলে¬খ করে বিজিবি’র ডিজি আরও বলেন, ‘তালি বাজানোর জন্য দুই হাত লাগবে। আমাদের দেশেও অনেক লোক এর সঙ্গে জড়িত। এক্ষেত্রে আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে তাদের কাস্টডিতে নিয়ে আসবো। পুলিশও তাদের ধরার চেষ্টা করছে। এসব ক্ষেত্রে আমরা হয়তো তেমন অ্যাকটিভ হতে পারিনি। আশা করি আপনাদের সহযোগিতা পেলে, আমাদের ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট যদি আরেকটু স্ট্রং হয়, তাহলে সমস্যাটা সমাধান করতে পারবো।’

মেজর জেনারেল আবুল হোসেন আরও বলেন, ‘সমস্যাটা আমরা চিহ্নিত করে ফেলেছি। এখন আমাদের চিহ্নিত করতে হবে-এর উৎস কোথায়, কোথায় যায়। ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। এছাড়া মাদক অধিদফতরও আছে। তারাও কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা তো ভেতরে কাজ করতে পারি না। আমরা বর্ডারে কাজ করি। বর্ডারে খুব কম সময় থাকে চোরাকারবারিরা। দ্রুত পার হয়ে ভেতরে চলে আসে। এখানে বলতে পারেন বর্ডারটা আপনারা নিশ্ছিদ্র করেন না কেন? বাংলাদেশ বর্ডার পোরাস বর্ডার। আমার বর্ডারে রাস্তা নেই। আপনি যদি মিয়ানমারের বেল্টে যান, দেখবেন রাতের বেলায় ১০ গজ দূরে আর কিছু দেখা যায় না। আবার কোনও কাঁটাতারের বেড়া নেই, রাস্তাও নেই। আমাদের লোক একদিকে টহল দিলে আরেক দিকে খালি থাকে। পোরাস বর্ডারে এরকমই হয়। আমাদের সরকারও সচেতন। আমরা চেষ্টা করছি, সার্ভিলেন্স ডিভাইসের মধ্যে লোকজনকে নজরদারিতে নিয়ে আসতে। এ ক্ষেত্রে অনেকটা সফলও হয়েছি। গত এক বছরে প্রায় পৌনে দুই কোটি ইয়াবা চালান ধরেছি। ধরাটাই বড় কথা নয়। বড় কথা হলো এটা বন্ধ করা। আমরা আশাবাদী। চেষ্টাও করছি। সীমান্তে রাস্তাটা করে ফেলতে পারলে ও কিছু ফ্লাডলাইট লাগাতে পারলে কাজে লাগবে। কারণ, রাতের বেলায়ই ইয়াবা বেশি আসে। রাতের ১২ ঘণ্টা কন্ট্রোল করতে পারলে ইয়াবাসহ সব ধরনের চোরাচালান আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবো।’

বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরও ইয়াবা চালান বন্ধ হচ্ছে না কেন, জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘ইয়াবা চালান বন্ধ না হওয়ার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে, মানুষ ইয়াবা সেবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন চাহিদা থাকলে তো জোগান আসবেই।’

বর্তমানে কারা ইয়াবা চালানের সঙ্গে জড়িত- এমন প্রশ্নের জবাবে জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘এখনও কিছু রোহিঙ্গা ইয়াবা চালানের বাহক হিসেবে কাজ করছে। ইয়াবাসহ মাদক চোরাচালান বন্ধে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ জন্য প্রতিদিনই আমরা অভিযান চালাচ্ছি। ইয়াবা আটক করছি।’ নৌসীমান্তে কাজ করছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড বাহিনী। প্রায়ই ইয়াবাসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য জলপথে আটক করছেন এই বাহিনীর সদস্যরা। ইয়াবা পাচার বন্ধ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কোস্ট গার্ড বাহিনীর পূর্ব জোনের টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম ফয়জুল ইসলাম ম-ল বলেন, ‘মিয়ানমারে তো আছেই। বাংলাদেশেও অনেক অসাধু লোক এই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দুই দেশে অবস্থান করা কিছু রোহিঙ্গাও জড়িত আছে এই ইয়াবা ব্যবসায়ের সঙ্গে। যারা ইয়াবার সঙ্গে ধরা পড়ছে, তারা মূলত বাহক। মূল ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে ধরা গেলে ইয়াবার চালান কমে আসবে।’