লাগামহীন আমদানিতে উদ্বেগ

ঢাকা: চলতি অর্থবছরে আমদানি খরচ ৬ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আভাস দিয়েছেন অর্থনীতির গবেষকগণ। বর্তমান দরে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা; যা চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের চেয়ে এক লাখ কোটি টাকা এবং আগামী অর্থবছরের সম্ভাব্য বাজেটের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি।

এই তথ্য জানিয়ে লাগামহীন আমদানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির গবেষকরা। তারা জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেই (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি ব্যয় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি মাসেই বাড়ছে আমদানি। বাড়ছে এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ। আমি হিসাব করে দেখেছি, সব মিলিয়ে এবার আমদানি ব্যয় ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
কেন বাড়ছে?

কেন আমদানি বাড়ছে- এ প্রশ্নের উত্তরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির যে উল্লম্ফন যেটা মূলত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানির কারণে বাড়ছে। এছাড়া চাল, জ্বালানি তেল, ক্যাপিটাল মেশিনারি এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়ার কারণেও আমদানি ব্যয় বাড়ছে।

গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কী পরিমাণ পণ্য বা যন্ত্রাংশ আমদানি হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে এই সময়ে খাদ্য (চাল ও গম) আমদানি বেড়েছে ২১২ শতাংশ। ক্যাপিটাল মেশিনারি বা মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি।

রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক পণ্য আমদানির সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ৪০ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭৫ শতাংশ বেশি।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ২৩ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।

এই ছয় মাসে চাল আমদানির এলসি বেড়েছে ১১৩৫১ শতাংশ। গমের এলসি বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। পেঁয়াজ, ৮০ শতাংশ, জালানি তেল ২৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমানির এলসি ৩৫ শতাংশ বেড়েছে।
প্রভাব কী?
আমদানি বাড়ায় অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে- এ প্রশ্নের উত্তরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা আহসান মনসুর বলেন, স্বাভাবিকভাবে আমদানি বাড়াকে অর্থনীতিতে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অনেক সময়ই আমরা শুনি যে, এক পণ্য আমদানির নামে অন্য পণ্য আমদানি হচ্ছে। অনেক সময় শূন্য কন্টেইনারও আসছেৃ। আবার ওভার ইনভয়েসের (আমদানি করা পণ্যের বেশি মূল্য দেখিয়ে) মাধ্যমে অর্থ পাচার করছেন অনেকে।
সে কারণেই এই আমদানি বাড়াকে আমি শুধু ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছি না, উদ্বিগ্নও খানিকটা, বলেন তিনি।
আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ার শঙ্কা জানিয়ে আহসান মনসুর বলেন, একটা দিক দিয়ে এতদিন আমরা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ছিলাম। রিজার্ভ প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলারে উঠে গিয়েছিল। কিন্ত আমদানি বাড়ায় সেটা আর থাকবে না। আমার তো মনে হয় খুব শিগগিরই রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে।
যদি রফতানী আয় ও রেমিটেন্স বাড়তো তাহলে সমস্যা হতো না। আমদানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও রেমিটেন্স ও রফতানী আয় বাড়ছে ধীর গতিতে, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রোববার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে আসবে বলে তথ্য দেন আহসান মনসুর।
রফতানী উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রফতানী আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। আর চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ২৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে।
গত বছরের ২২ জুন রিজার্ভ ছাড়ায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ৩৩ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার; ২০১৭ সালের জুলাই শেষে।
আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশকে দুই মাস পরপর পরিশোধ করতে হয় আকুর বিল।