হাজরে আসওয়াদ পাথরের কথা

হাজরে আসওয়াদ মূলতঃ কোন পাথর নয়, প্রকৃত পক্ষে হাজরে আসওয়াদ একজন ফেরেশ্তা ছিলেন। আর হাজরে আসওয়াদ খালেছ নিয়তে চুম্বনকারী ব্যক্তির গুনাহ্ চুষে নেয়।

হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে তাফসীরের কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ পাক যখন হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হযরত হাওয়া আলাইহাস সালাম-কে সৃষ্টি করে বেহেশতে অবস্থান করার ব্যবস্থা করে দিলেন। তখন আল্লাহ পাক হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হযরত হাওয়া আলাইহাস সালাম-কে বলেছিলেন, “আপনারা উভয়ে এ গাছের (গন্ধমের) নিকটবর্তী হবেনা না।” [সূরা বাক্বারা ৩৫]

হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হযরত হাওয়া আলাইহাস সালাম যাতে এ আদেশ যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, আর বিতাড়িত ইবলিশ যাতে তাঁদেরকে নিষিদ্ধ গন্ধম গাছের ফল খাওয়াতে না পারে, সেজন্য একজন ফেরেশ্তা মোতায়েন করেছিলেন। শয়তান যখন মিথ্যা কসম খেয়ে, মিথ্যা কথার দ্বারা হযরত হাওয়া আলাইহাস সালাম-এর মাধ্যমে অনুরূপ বিপরীতে দিকের অন্য একটি গাছের ফল হযরত আদম আলাইহিস সালামকে তাঁর অজান্তে খাওয়ালেন, তখন আল্লাহ পাক উক্ত পাহারদার ফেরেশ্তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিতাড়িত ইবলিশ যখন মিথ্যা কসম খেয়ে, মিথ্যা কথার দ্বারা তাঁদেরকে নিষিদ্ধ গন্ধম গাছের ফল খাওয়ালো, তখন তুমি কোথায় ছিলে? ফেরেশ্তা জবাবে বললেন, আল্লাহ পাক আপনার দেয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আসছিলাম কিন্তু এতে কোন প্রকার অঘটনের কিছু না দেখে আপনার সুন্দরতম সৃষ্টি বেহেশত দেখার জন্য অন্যদিকে গিয়েছিলাম, এ সময়ের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটে যায়।

আল্লাহ পাক বললেন, যেহেতু হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হযরত হাওয়া আলাইহাস সালাম উভয়ে গন্ধম ফল খেয়েছেন, সেহেতু তাঁদেরকে যমিনে চলে যেতে হবে। আর সেখানে তাঁদের সন্তান জম্মগ্রহণ করবে, তাদের পক্ষে দুনিয়ার গুনাহ্ থেকে বেঁচে থাকা কঠিন হবে। এখন তোমাকে তাঁদের সাথে গিয়ে তাঁদের সন্তানদের যে গুনাহ্ হবে, তা তোমাকে ক্ষমা করাতে হবে।

তখন ফেরেশ্তা বললেন, আল্লাহ পাক! আপনার আদেশ তো অবশ্যই পালন করবো। কিন্তু প্রত্যেকের বাড়ী বাড়ী গিয়ে কি করে সম্ভব? কারণ আমি একদিক থেকে আদম সন্তানের গুনাহ্ ক্ষমা করাতে করাতে যখন অন্যদিকে যাবো, তখন যেদিক থেকে ক্ষমা করিয়ে আসবো সেদিকে আবার আদম সন্তান নতুন করে জন্মগ্রহণ করবেন। তাঁদের গুনাহ ক্ষমা করার জন্য পুণরায় তাঁদের কাছে যেতে হবে। সেটা কি করে সম্ভব, তা আমার কাছে দূরূহ মনে হচ্ছে। আপনি দয়া করে আমাকে কোন এক নির্দিষ্ট স্থানে রাখলে সেখানে আদম সন্তানগণ এসে আমাকে চুম্বন বা স্পর্শ করলেই আমি তাদের গুনাহ চুষে নিবো। তখন আল্লাহ পাক বললেন, “বেশ। তাই হবে। তোমাকে ক্বাবা শরীফে স্থাপন করা হবে।” এবং সে অনুযায়ী উক্ত ফেরেশ্তাকে পাথরের আকৃতিতে ক্বাবা শরীফের দক্ষিণ পূর্ব কোণে দরজার পাশে স্থাপন করা হয়। [সমূহ তাফসীরের কিতাব]

এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে নাযিল হয়েছে এবং সেটা দুধ অপেক্ষা সাদা ছিল, অতঃপর আদম সন্তানের গুনাহ্র কারণে সেটা কালো হয়ে গিয়েছে।” [আহ্মদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ, নুজহাতুল মাজালিশ, দর্সে তিরমিযী, মেশকাত শরীফ, মেরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুমায়াত, তা’লীক, মোযাহেরে হক্ব]

হাদীস শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে, “হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ্ পাক-এর কসম! ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ্ পাক হাজরে আসওয়াদকে দুটি চোখ দান করবেন, তা দ্বারা সে দেখতে পাবে এবং একটি জিহ্বা দান করবেন, তা দ্বারা সে কথা বলবে। যারা আন্তরিকতার সাথে তাকে চুম্বন করেছে, তাদের সম্বন্ধে সে সাক্ষ্য দিবে।” [তিরমিযী শরীফ, ইবনে মাযাহ শরীফ, দারেমী শরীফ, মেশকাত শরীফ, মেরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুমায়ত, লুমায়ত, মুযাহিরে হক্ব, নুজহাতুল মাজালিশ]

তাওয়াফ করার সময় হাজীগণ বরকতের কারণে হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “হযরত আবেস বিন রাবেয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কে ‘হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন করতে দেখেছি। তিনি বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমি জানি তুমি একখানি পাথরমাত্র, কোন উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা তোমরা নেই। যদি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখতাম, তবে কখনোই আমি তোমায় চুম্বন করতাম না। একথা বলে হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু চুম্বন করতে থাকেন। তখন হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! হাজরে আসওয়াদ উপকার বা অপকার উভয়ই করতে পারে। হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জিজ্ঞেস করলেন, তা কিরূপে? হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আল্লাহ্ পাক আলমে আরওয়াহ্তে যখন সমস্ত বনী আদমের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, তখন তাঁর একটি পূর্ণ তালিকা তৈরী করা হয়েছিল। সেই পূর্ণ তালিকাটি হাজরে আসওয়াদ গ্রাস করেছিল। ওটা এখন ঈমানদারগণের অঙ্গীকার পূরণ করার পক্ষে এবং কাফেরদের অঙ্গীকার পূরণ না করার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে।” [ইহ্ইয়াউল উলুমুদ্দিন]

অনেকে বলে থাকে হাজরে আসওয়াদে চুম্বনের ব্যাপারে কুরআন শরীফে কোন বর্ণনা নেই। অথচ আল্লাহ পাক বলেন, “রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কোন কথাই ওহী ব্যতীত নিজ থেকে বলেন না” [সূরা নজম ৩-৪]

উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা এটা স্পষ্টই বুঝা যায় যে, হাদীস শরীফগুলোও কুরআন শরীফের ন্যায় ওহীর অন্তর্ভূক্ত। কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীস শরীফও শরীয়তের অকাট্য দলীল। কারণ হাদীস শরীফ ব্যতীত উম্মতের জন্য কুরআন শরীফের সঠিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। অতএব, কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীস শরীফ মানা ও তার অনুসরণ-অনুকরণ করাও অবশ্যই কর্তব্য। আর তাই আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “আমার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা আকঁড়ে ধর এবং যার থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তা থেকে বিরত থাক।” [সূরা হাশর ৭]

উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা হাদীস শরীফ অনুসরণ-অনুকরণ করা ফরয প্রমাণিত হয়। সুতরাং যে বা যারা হাদীস শরীফ অস্বীকার করবে এবং তার অনুসরণ-অনুকরণ করবেনা, তারা গোমরাহ্ ও বাতিল এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “সুতরাং যারা তাঁর (রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর) আদেশের বিরোধীতা করে, তাদের ভয় করা উচিৎ যে, তাদের উপর এসে পড়বে কোন ফিতনা বা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” [সূরা নূর ৬৩]

এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “হযরত আবূ রা’ফে রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি তোমাদের কাউকে যেন এরূপ না দেখি যে, সে তার গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে। আর তার নিকট আমার আদেশাবলীর কোন একটি আদেশ পৌঁছাল, যাতে আমি কোন বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ করেছি। তখন সে বলবে, আমি এসব কিছু জানি না, আল্লাহ পাকের কিতাবে যা পাবো, তাই অনুসরণ করবো।” [তিরমিযী শরীফ,আবূ দাউদ শরীফ, ইবনে মাজাহ্ শরীফ, আহ্মদ শরীফ, মিশকাত শরীফ, মায়ারিফুস সুনান, বযলুল মাজহুদ, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, আত্ তা’লীকুছ্ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব]

হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, “হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, একদিন আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আমাদের মধ্যে) দাঁড়ালেন এবং বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার গদীতে হেলান দিয়ে একথা মনে করে যে, আল্লাহ পাক যা এ কুরআন শরীফে হারাম করেছেন তা ব্যতীত তিনি আর কিছুই হারাম করেননি। তোমরা জেনে রাখো, আমি আল্লাহ পাক-এর কসম দিয়ে বলছি! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের অনেক বিষয় আদেশ দিয়েছি, উপদেশ দিয়েছি এবং অনেক বিষয় নিষেধও করেছি, আমার এরূপ বিষয়ও নিশ্চয়ই কুরআন শরীফের বিষয়ের সমান। বরং তা থেকেও অধিক হবে। তোমরা মনে রাখবে যে, অনুমতি ব্যতীত আহ্লে কিতাব যিম্মীদের বসতঘরে প্রবেশ করা, তাদের নারীদের প্রহার করা এবং তাদের ফল-শস্য খাওয়াকে আল্লাহ পাক তোমাদের জন্য হালাল করেননি, যদি তারা তাদের উপর নির্ধারিত কর আদায় করে দেয়। (অথচ এ সকল বিষয়ে কুরআন শরীফে নেই। আমার মাধ্যমেই আল্লাহ পাক হারাম করেছেন)” [আবূ দাউদ শরীফ, মিরকাত শরীফ]

উপরোক্ত আয়াত শরীফ এবং হাদীস শরীফ দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীস শরীফ মানা ও তার অনুসরণ-অনুকরণ করাও অবশ্যই কর্তব্য।

আবার অনেকে হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা মূর্তিপুজার সমতূল্য বলে মনে করে থাকে। অথচ হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা মুশরিকদের অর্থাৎ মূর্তিপুজকদের বিপরীত আমল কর।” [বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ]

হাদীস শরীফে আরো এসেছে,“আল্লাহ পাক আমাকে বাদ্যযন্ত্র এবং মূর্তি ধ্বংস করার জন্য প্রেরণ করেছেন।”
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,“নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক আমাকে প্রেরণ করেছেন সমস্ত জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ এবং হেদায়েতস্বরূপ। আর আদেশ করেছেন বাদ্যযন্ত্র, মূর্তি, ক্রুশ ও জাহিলী কাজসমূহ ধ্বংস করার জন্য।” [আহ্মদ শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ]

“সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়শঃই হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করতেন। সুতরাং উক্ত কাজটি মূর্তিপুজা তো নয়ই বরং সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাই কেউ যদি সুন্নতের খেয়ালে এটা চুম্বন করে, তাহলে সে আল্লাহ পাক-এর তরফ হতে অশেষ সন্তুষ্টি ও রহমত লাভ করবে এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি সুন্নত আদায় করার তৌফিক লাভ করবে।”

আর যে সুন্নতকে অস্বীকার করবে তার সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে, “যদি তোমরা তোমাদের নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নত তরক বা অস্বীকার করো তাহলে অবশ্যই তোমরা কাফির হয়ে যাবে।” [আবূ দাউদ শরীফ]

হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, “যদি তোমরা তোমাদের নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নত তরক (অস্বীকার) করো তাহলে তোমরা গুমরাহ হয়ে যাবে।” [আবূ দাউদ শরীফ]

আর আক্বাইদের কিতাবে বর্ণিত রয়েছে, “সুন্নতকে ইহানত করা কুফরী।”