স্বর্ণ চোরাচালানে আরেক নাম ‘রিয়াজউদ্দিন বাজার’

নিউজ ডেস্ক:
২০১০ সালের নভেম্বর মাসের শীতের রাত। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন এলাকা থেকে বাবুল শেখ নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তল্লাশি করে পাওয়া যায় তিনটি স্বর্ণের বার ও দুই লাখ ৩৮ হাজার ৯০০ ভারতীয় রুপি। সেই সূত্রেই নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে গ্রেফতার করা হয় আজিজ নামে আরও একজনকে। সে সময় র‌্যাব জানায় গ্রেফতার দুজনেই আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের সদস্য।

এই ঘটনার নয় বছর পর রোববার (০৩ মার্চ) দুপুর ১টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জোরারগঞ্জে একটি জিপ তল্লাশি করে প্রায় ২৭ কোটি টাকা মূল্যের ৬০০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে জেলা পুলিশ। এই ঘটনার মাত্র দুই ঘণ্টার আগে চট্টগ্রাম নগরের সিআরবি সাতরাস্তার মোড় এলাকা থেকে অপর একটি প্রাইভেট কারে তল্লাশি চালিয়ে ১০০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
সাদামাটা হিসেবে ৯ বছরের ব্যবধানে এই তিনটি ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই। পৃথক সময়ে পৃথক আদলের তিনটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আসলে কি তাই?

এই হিসেব মেলানোর জন্য আমরা পাঠকের সামনে তুলে ধরছি গত নয় বছরে চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়া নির্দিষ্ট কয়েকটি স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনা।

সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার এখনও চট্টগ্রামে একটি আলোচিত নাম। ২০১৬ সালে তিনি নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছিলেন। বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে ওই বছরের ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের বাহার মার্কেট অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয় তিনটি সিন্দুক। উদ্ধার হওয়া একটি সিন্দুক থেকে ২৫০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আরেকটি সিন্দুক থেকে পাওয়া যায় নগদ ৬০ লাখ টাকা। অপরটি খালি ছিল।

এ ঘটনায় নগরের কোতোয়ালি থানায় আন্তঃদেশীয় স্বর্ণ চোরাচালানকারী আবু আহম্মদ ও তার ম্যানেজার এনামুল হক ওরফে নাঈমকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। দুবাই কেন্দ্রিক চোরাকারবারি আবু আহম্মদের সাবেক ম্যানেজার এনামুল হক ওরফে নাঈম পুলিশ রিমান্ডে স্বীকারোক্তি দেন, ‘দুবাই থেকে চোরাচালান চক্রের পাঁচ সদস্য স্বর্ণ পাঠায় চট্টগ্রামে। সেই স্বর্ণ রিয়াজউদ্দিন বাজারে নিয়ে আসা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে চক্রের আরও পাঁচ সদস্য। স্বর্ণ চোরাচালান ব্যবসা পরিচালনায় আবুকে সহযোগিতা করেন দুই ব্যবসায়ী নেতা ও এক ব্যবসায়ী। চোরাচালানের স্বর্ণ বিক্রির টাকা হুন্ডির মাধ্যমে আবুর কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজে সহায়তা করেন এক বিতর্কিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও সাবেক এক চসিক কাউন্সিলর।’

২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট থানার আনু মাঝির ঘাট এলাকায় ‘এসি মেলা’ নামে একটি ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের গুদামে অভিযান চালিয়ে অলঙ্কারসহ ২০ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে পুলিশ। সে ঘটনাতেও আলোচনায় উঠে আসে রিয়াজউদ্দিন বাজারের নাম।

ওই ঘটনার দুই মাস পর ২০১৫ সালের ২৩ জুন নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় প্রাইভেট কারের তল্লাশি চালিয়ে ১২০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে বায়েজিদ থানা পুলিশ। সেই স্বর্ণ পাচারের ঘটনার পেছনে ছিলেন ফটিছড়ির জাফতনগর ইউনিয়নের বাসিন্দা মাহবুবুল আলম ওরফে আলমগীর।

সূত্র জানায়, ফটিকছড়ির আলমগীর এক সময় রিয়াজউদ্দিন বাজারের হুন্ডি ব্যবসায়ী তাহের চৌধুরীর অধীনে চাকরি করতেন। পরে তিনি হয়ে উঠেন স্বর্ণ পাচারকারী।

সর্বশেষ রোববার (৩ মার্চ) ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জোরারগঞ্জে জিপ তল্লাশি করে প্রায় ২৭ কোটি টাকা মূল্যের ৬০০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেফতার দুইজন পুলিশকে জানিয়েছে, তারা এই বিপুল স্বর্ণের চালান সংগ্রহ করেছে নগরের কোতোয়ালী থানার স্টেশন রোড অর্থাৎ রিয়াজউদ্দিন বাজারের আশপাশের এলাকা থেকে।

এছাড়া ওই ঘটনার দুই ঘণ্টা আগে নগরের কোতোয়ালী থানার সিআরবি সাতরাস্তার মোড় এলাকা থেকে অপর একটি প্রাইভেট কারে তল্লাশি চালিয়ে ১০০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। যদিও আসামিরা নগরের কোনো একটি মাজার এলাকা থেকে স্বর্ণের বারগুলো সংগ্রহের দাবি করেছেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সিআরবি সাতরাস্তার মোড় থেকে আলোচিত রিয়াজউদ্দিন বাজারের দূরত্ব মাত্র আধ কিলোমিটার।

এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা মামলার তদন্তভার পেয়েছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. আবুল কালাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ১০০ স্বর্ণবারসহ গ্রেফতার দুই ব্যক্তি মো. বিলাল হোসেন (২৮) ও লাভু শাহা ওরফে প্রলয় কুমার শাহা (৫৯) নিজেদের স্বর্ণ চোরাচালানের বাহক বলে স্বীকার করেছে। তবে তারা কোথা থেকে এ স্বর্ণ সংগ্রহ করেছেন তা নির্দিষ্ট করে বলছেন না।

তাদের ভাষায়, কোনো একটি মাজার এলাকা থেকে তারা অন্য একজন থেকে ১০০ পিস স্বর্ণের বার গ্রহণ করেন। তাদের গাড়ির গতিপথ বিবেচনায় ধারণা করছি, নগরের বদনা শাহ’র মাজার এলাকা থেকে ওই দুই ব্যক্তি স্বর্ণের বারগুলো সংগ্রহ করেছেন।’

চোরাকারবারিরা পুলিশকে যে বক্তব্য দিয়েছে এবং পুলিশের ধারণার মধ্যে বড় ধরনের একটি ফারাক পাওয়া যায়। গ্রেফতার ব্যক্তিরা পুলিশকে জানিয়েছেন, বদনা শাহ’র মাজার এলাকা থেকে স্বর্ণের বার সংগ্রহ করে তা নিয়ে নারায়নগঞ্জ যাচ্ছিল। কিন্তু তারা বদনা শাহ’র মাজার তথা প্রবর্তক মোড় থেকে জিইসি হয়ে কেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উঠার চেষ্টা করলো না? কী কারণে সম্পূর্ণ উল্টো পথের সিআরবি সড়ক বেছে নিল? আসলেই কি তারা বদনা শাহ’র মাজার থেকে রওনা দিয়েছিল? তা যদি না হয়, তবে নিউমার্কেট বা আলোচিত রেয়াজউদ্দিন বাজার থেকে মেরিনার্স রোড হয়ে সিআরবিতে পৌঁছানো তাদের জন্য সবচেয়ে সহজ ও নির্ভেজাল রুট ছিল। সেই সব প্রশ্নের উত্তর পেতে হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হতে পারে আমাদের।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) এস এম মোস্তাইন হোসেন বলেন, ‘মিরসরাইয়ে আটক স্বর্ণের বারগুলোর সঙ্গে নগরে আটক স্বর্ণের বারগুলোর হুবহু মিল রয়েছে। তবে দুই ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না- তা তদন্তে জানা যাবে। জোরারগঞ্জ থানা জানিয়েছে- তাদের আটক করা স্বর্ণের চালানটি স্টেশনরোড থেকে সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু সিআরবির স্বর্ণগুলো কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। এ দুটি ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। আজ থেকে আসামিদের রিমান্ড শুরু হয়েছে। ইনশাল্লাহ এর শেষ দেখে ছাড়বো। রিয়াজউদ্দিন বাজার বা অন্য কোনো এলাকা আমাদের সন্দেহের বাইরে নয়।’

জোরাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হাসান বলেন, ‘জোরারগঞ্জ থেকে আটক স্বর্ণ চোরাকারবারিরা জানিয়েছে তারা এই স্বর্ণ বারগুলো ঢাকা নিয়ে যাচ্ছিল। এর আগে সকালে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন এলাকা (রিয়াজউদ্দিন বাজারের পাশে) থেকে স্বর্ণের বারগুলো সংগ্রহ করে তারা। গ্রেফতার করিম ও রাকিব দুজনের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনাতে। সে হিসেবে তাদের বাড়ির পাশেই ভারত সীমান্ত। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, করিম নিজেই স্বর্ণ চোরাচালান দলের সক্রিয় সদস্য। এই স্বর্ণ বারগুলো চুয়াডাঙ্গা দিয়ে ভারতে পাচারের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। তার আরেক ভাই চোরাচালান মামলায় পলাতক আছে। এর আগে করিমের বিরুদ্ধেও স্থানীয় দামুড়হুদা থানায় চোরাচালানের দায়ে একটি মামলা আছে।’

‘কোনো জায়গা থেকে স্বর্ণের বারগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে সেই তথ্য মামলার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসামিদের আরও জিজ্ঞাসাবাদে অথেনটিক তথ্যের ভিত্তিতে যা করা প্রয়োজন আমরা তা করবো।’- বলেন ওসি ইফতেখার হাসান।