সিন্ডিকেটের ছোবলে বাড়লো বস্তাপ্রতি চালের দাম

সিন্ডিকেটের ছোবলে বাড়লো বস্তাপ্রতি চালের দাম

চট্টগ্রাম সংবাদদাতা: কৃষকের উৎপাদিত ধানের নায্যমূল্য নিশ্চিত করতে দুই মাস ধরে চাল আমদানি বন্ধ রেখেছে সরকার। এই সুযোগে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা পর্যন্ত চালের দাম বাড়িয়েছে চাল ব্যবসায়ীরা।

চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে দুই মাস ধরে চাল আমদানি বন্ধ রেখেছে সরকার। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন আমিদানিকারকরা। আগে আমদানি করা চাল এখন বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। প্রচুর মজুত থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আমদানিকৃত ৫০ কেজির বস্তা চালের দাম ৩০০ টাকা বাড়িয়েছেন আমিদানিকারকরা।

বাংলাদেশ মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলী বলেন, নতুন মৌসুমে ধান-চাল বাজারে এলেও সরবরাহ বাড়েনি। আমদানিকৃত ভারতীয় চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বাজারে দামে প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলসহ ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে।

সরকার চাল আমদানির জন্য আমদানিকারদের সর্বশেষ অনুমতি দেয় চলতি বছরের ২৫ আগস্ট। সেসময় ৪০০ আমদানিকারককে সাড়ে ১৬ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। ৩০ অক্টোবরের মধ্যে এসব চাল আমদানি শেষ করতে বলা হয়। ৩১ অক্টোবর থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় ভারত থেকে চাল আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমদানি বন্ধের আগে প্রচুর চাল আমদানি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আখতারুজ্জামান জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে চট্টগ্রাম জেলায় অন্তত এক হাজার ৮৮ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে রোপা আমনও ছিল। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এই ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি হতে পারে। এর প্রভাব চাল বাজারে পড়েছে।

চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, ভারত থেকে চাল আমদানি বন্ধ থাকায় ভারতীয় চালের সরবরাহ স্বাভাবিকভাবেই কম। সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়িয়েছেন আমদানিকারকরা।

চাক্তাই চাল বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী শান্ত দাশগুপ্ত জানায়, আমন মৌসুমের চাল আসার পর দাম কিছুটা কমার কথা। কিন্তু সরকার ধান-চাল সংগ্রহের জন্য চালের বাড়তি দাম নির্ধারণ করেছে। কৃষকদের ক্ষেত্রে কেজিতে এক টাকা বাড়ালেও মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহে কেজিতে তিন টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে খোলা বাজারে কৃষকের চালের সরবরাহ কমে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে। আবার আশুগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহের চাল ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিরা দেশের বাজারগুলো পর্যবেক্ষণ করে আড়তদারদের খবর দেন। তারা অবস্থা বুঝে দাম বাড়ান। আবার সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন।

আমন মৌসুমকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। গত ৮ নভেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমানারা খাতুন স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহ নীতিমালা অনুসারে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় মিলারদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে আমন ধানের সরকারি ক্রয়মূল্য কেজিপ্রতি ২৭ টাকা, চালের মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এই দামে সরকার তিন লাখ টন ধান ও পাঁচ লাখ টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে।

দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন মোকাম থেকে চাল সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনিতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালের বাজার কিছুটা বাড়তি ছিল। কিন্তু নতুন মৌসুমের চাল সরবরাহ শুরু হলে বাজারে সংকট দেখানো হচ্ছে মোকামগুলো থেকে। যার কারণে এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বস্তাপ্রতি ১০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে ভারতীয় চালের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি ৪০০ টাকা পর্যন্ত।

চালের সরবরাহ কমের কারণ জানতে চাইলে চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, সংকটের কথা অনেকে জানেন। কিন্তু এগুলো প্রমাণ করতে হলে দেশের আড়তগুলোতে খোঁজ নিতে হবে।

যদিও লায়েক আলী দাবি করেছেন, নতুন মৌসুমের ধান-চাল বাজারে এলেও সরবরাহ বাড়েনি। তবে তিনি আমদানিকৃত চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশি বাজারেও দাম বেড়েছে বলে স্বীকার করেছেন। চালের বাজারে জ্বালানি তেলসহ ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।

কোন চালের দাম কেমন বেড়েছে:

খাতুনগঞ্জের চাক্তাই বাণিজ্যিক এলাকার বিভিন্ন আড়তে দেখা গেছে, স্বর্ণা সেদ্ধ চালের বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ১০০ টাকা, মিনিকেট সেদ্ধ মানভেদে ৩০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৪০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা, পাইজাম সেদ্ধ চাল ৩০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৪০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা, কাজলতা সেদ্ধ ২০০ টাকা বেড়ে দুই হাজার ৭০০ টাকা, জিরাশাইল সেদ্ধ ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ১০০ টাকা।

অপরদিকে, আতপ চালের মধ্যে মিনিকেট বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৭০০ টাকা, বেতি সেদ্ধ ২০০ টাকা বেড়ে মানভেদে দুই হাজার ৩০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা, ইরি আতপ ১৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে বস্তাপ্রতি এক হাজার ৯৫০ টাকা, কাটারি আতপ ৩০০ টাকা বেড়ে তিন হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজারে দাম বাড়ায় খুচরা বাজারেও চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে পাঁচ-ছয় টাকা।