রুশ-মার্কিন ভারতের পাশে, পাকিস্তানের সঙ্গ ে চীন!

ডেস্ক: ব্রিকস সম্মেলন শুরুর ঠিক আগে আন্তর্জাতিক মহলের বড় অংশের কাছে পাকিস্তানকে নতুন করে কোণঠাসা করার লক্ষ্যে আরও একধাপ এগোলো ভারত। আজ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার যুযুধান দুই রাষ্ট্র, আমেরিকা ও রাশিয়া সন্ত্রাস প্রশ্নে কার্যত এক সুরে সমর্থন করল ভারতকে। অভিযোগের তর্জনী তুলল ইসলামাবাদের দিকে। পাক-সন্ত্রাসের নিন্দায় বেশির ভাগ বড় দেশ একজোট হলেও চিন অবশ্য সেই পথে হাঁটেনি। পুরনো অবস্থান বজায় রেখে সন্ত্রাস তো বটেই, জঙ্গি-নেতা মাসুদ আজহার প্রশ্নেও ইসলামাবাদকে ভরসা দিয়েছে বেইজিং।

রোববার ভারতীয় গণমাধ্যমে এমন সংবাদটি প্রকাশ করেছে।

সংবাদে বলা হয়, ওয়াশিংটনে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রী মুখপাত্র মার্ক টোনার এ দিনই সরাসরি পাকিস্তানের নাম করে তাদের মাটিতে সমস্ত জঙ্গি সংগঠন ও তাদের মাথাদের নির্মূল করার দাবি তুলেছেন। এ দিনই গোয়ায় ব্রিকসের প্রাক্কালে ভারত-রাশিয়া যৌথ বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে পাশে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘‘সীমান্তপার সন্ত্রাস রোখার প্রশ্নে মস্কো পাশে দাঁড়ানোয় আমরা খুশি। সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে রাশিয়া ও ভারত এক নীতিতে বিশ্বাস করে। আমাদের মতো রাশিয়াও মনে করে, সন্ত্রাসের সঙ্গে কোনও ধরনের সমঝোতা করা উচিত নয়।’’ উরির সেনা ছাউনিতে হামলার তীব্র নিন্দা করে রাশিয়া যে ভাবে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে, তা নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মোদী।

উরি-কাণ্ডের পরবর্তী পর্যায়ে সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির মধ্যে পাকিস্তানকে একঘরে করতে সক্ষম হয়েছে ভারত। আজ আরও এক ধাপ এগিয়ে বিশ্বের অন্যান্য বড় দেশগুলির কাছেও ইসলামাবাদকে ব্রাত্য করার কাজ সফল ভাবে শুরু করা গেল বলেই মনে করছে বিদেশ মন্ত্রক। নয়াদিল্লির বক্তব্য, আগামিকাল নিশ্চিত ভাবেই ব্রিকস ঘোষণাপত্রে সীমান্তপারের সন্ত্রাস প্রসঙ্গ বড় জায়গা নিতে চলেছে। ব্রিকস ও তার পর বিমস্টেকভুক্ত দেশগুলির আলোচনায় আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের প্রসঙ্গটি নিশ্চিত ভাবেই উঠতে চলেছে। পাকিস্তানের মদতেপুষ্ট জঙ্গিরা যে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে হামলা চালাচ্ছে, ওই বৈঠকে সেই প্রমাণ তুলে ধরবে দিল্লি। এবং এই সন্ত্রাস রুখতে ব্রিকস ও বিমস্টেকভুক্ত দেশগুলির মধ্যে সার্বিক সমন্বয় গড়ে তোলার ডাকও দেওয়া হবে ভারতের তরফে। দিল্লির যুক্তি, সন্ত্রাসের কোনও ভৌগোলিক সীমারেখা নেই। ভুগতে হতে পারে যে কোনও দেশকেই।

আজ ভারত-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পরেই সাংবাদিক বৈঠক করেন বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ব্রাজিলের মতো দেশগুলির কাছে পাক সন্ত্রাস কতটা প্রাসঙ্গিক? বিদেশসচিব বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সীমান্তপার সন্ত্রাসের সব থেকে বড় শিকার ভারত ঠিকই। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না, সন্ত্রাসের শাখাপ্রশাখা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সন্ত্রাস আজ আর আঞ্চলিক বিষয় নয়। এটি আন্তর্জাতিক সঙ্কট।’’

উরি-কাণ্ডের পর থেকেই আমেরিকার সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলছে নয়াদিল্লি। ওয়াশিংটনও তখন থেকেই সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তানের উপরে প্রবল চাপ তৈরি করে গিয়েছে। উরির ঘটনা সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদীদের কাজ বলে মন্তব্য করার পাশাপাশি ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’কে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে ওবামা প্রশাসন। অন্য পশ্চিমি দেশগুলিও ভারতের পাল্টা জবাবের বিরোধিতা করেনি।

ব্যতিক্রম একমাত্র চীন। সরাসরি পাকিস্তানের পাশে যে ভাবে তারা দাঁড়িয়েছে, তাতে উদ্বিগ্ন এবং ক্ষুব্ধ দিল্লি। শনিবারও চীন তাদের দীর্ঘদিনের ভারত-বিরোধিতার পথ ছাড়েনি। সন্ত্রাস নিয়েও না! চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর সঙ্গে মোদীর বৈঠকে সন্ত্রাসই ছিল মূল আলোচ্য। এবং সেখানে নয়াদিল্লির আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে সন্ত্রাসে পাকিস্তানের ভূমিকাকে লঘু করতে গিয়ে আইএস নিয়ে উদ্বেগের প্রসঙ্গ টেনে আনল চীন! পাঠানকোট ও উরি-কাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রী, পাক জঙ্গিনেতা মাসুদ আজহার সম্পর্কেও পুরনো সহানুভূতিই বজায় রেখেছে তারা। মাসুদকে রাষ্ট্রপুঞ্জে নিষিদ্ধ করা নিয়ে ভারতের প্রস্তাব আটকে রয়েছে চীনের আপত্তিতে। আজ বৈঠকে মাসুদ সম্পর্কে চীনের এই অবস্থান নিয়ে আপত্তির কথা জানান মোদী।

চীনা প্রেসিডেন্ট সবই শুনেছেন। সন্ত্রাস যে বড় সমস্যা, তা মেনেও নিয়েছেন। ওই পর্যন্তই! পাক জঙ্গি মাসুদ প্রসঙ্গে অবস্থান বদল করেননি। আগামিকাল চীনা বিদেশনীতি উপদেষ্টা ইয়াং জিয়েচির সঙ্গে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের বৈঠকে মাসুদ প্রসঙ্গ উঠবে। কিন্তু সাউথ ব্লকের কেউই আশা করছেন না যে, পাক জঙ্গিদের সম্পর্কে চীন কড়া অবস্থান নেবে।

চীন নিয়ে ‘প্রত্যাশিত’ হতাশা সত্ত্বেও আজ আমেরিকা যে ভাবে ইসলামাবাদের উপর চাপ তৈরি করেছে, তাতে খুশি সাউথ ব্লক। মার্কিন বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মার্ক টোনার এ দিন বলেন, ‘‘পাকিস্তানও মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসের শিকার। আমরা সেই সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানকে সাহায্যও করতে চাই। কিন্তু আমরা এটাও চাই, যে জঙ্গিরা পাকিস্তানের মাটিকে নিজেদের স্বর্গোদ্যান বানিয়েছে, তাদের নির্মূল করুক সে দেশের সরকার।’’ হাফিজ সইদ, মাসুদ আজাহারের মতো জঙ্গিনেতারা যে ভাবে পাকিস্তানে স্বাধীন ভাবে ঘুরে ক্রমাগত সন্ত্রাস ও যুদ্ধের জিগির তুলছে এবং পাক প্রশাসনের একাংশের সাহায্য পাচ্ছে, তা ভাল ভাবে নিচ্ছে না ওয়াশিংটন।

মাসুদ, হাফিজের মতো জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা না নিলে পাকিস্তান যে আন্তর্জাতিক স্তরে আরও এক ঘরে হয়ে পড়বে, তা ইতিমধ্যেই সেনা কর্তাদের কাছে ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। পাক সংবাদপত্রে সে খবর প্রকাশিত হওয়ায় বিব্রত পাক সরকার প্রথমে খবরটিকেই অস্বীকার করে। তার পরে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের উপর খড়্গহস্ত হতে গিয়ে ঘরেই বিদ্রোহের মুখে পড়ে। এই অবস্থায় পাক সেনার তরফে গত কাল যা বলা হয়েছে, তাতে অস্বস্তি বেড়েছে সরকারের। সেনা এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে হওয়া ওই বৈঠকের খবর ফাঁস হওয়া জাতীয় নিরাপত্তায় বড় আঘাত। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যেই আমেরিকার কড়া বার্তা নিঃসন্দেহে ইসলামাবাদের রক্তচাপ অনেকটাই বাড়িয়ে দিল।

কাল গোয়ার ব্রিকস সম্মেলনকে ‘পাক-সন্ত্রাস’ বিরোধী মঞ্চ হিসেবে তুলে ধরতে সক্রিয় বিদেশ মন্ত্রীকে আমলারা মনে করছেন, ব্রিকসের ঠিক শুরুতে ওয়াশিংটনের এই তির আসলে নয়াদিল্লিরই জয়। যেমন জয় রাশিয়ার সঙ্গে সাময়িক অনাস্থার মেঘ কিছুটা হলেও কাটিয়ে ফেলাটা। উরি-কাণ্ডের তীব্র নিন্দার পরেও রুশ-পাক যৌথ মহড়ায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিল দিল্লি। আজ অবশ্য বিদেশসচিব বলেন, ‘‘রাশিয়া এমন কিছু করবে না, যাতে ভারতের ভরসা নষ্ট হয়।’’ নয়াদিল্লি মনে করছে, আজ প্রতিরক্ষা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে করা ১৬টি চুক্তি যেমন দু’দেশের সম্পর্কে উষ্ণতা বাড়াবে, তেমনই পাকিস্তানের নতুন মাথাব্যথা হয়ে উঠবে। সংবাদ মাধ্যম