রহস্যেঃ চট্টগ্রাম পোশাক কারখানার আগুন

চট্টগ্রাম পোশাক কারখানার আগুন

নিজস্ব প্রতিবেদক : সন্ধ্যা ৭টায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত দাবি করা হলেও মূলত বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে গোল্ডেন সন এক্সপোর্ট লিমিটেড থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে গোল্ডেন সন এক্সপোর্ট লিমিটেড ও জিএসএল পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রহস্যের ডালপালা গজাচ্ছে। মিলছে না কোনো কূলকিনারা। এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন কারখানা কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। অনুসন্ধানে নেমে পুরো ঘটনায় বেশকিছু অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।

দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের কথা বলা হলেও বিকেল সাড়ে ৫টার দিকেই আগুনের সূত্রপাত হয় বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয়রা। এ সংক্রান্ত একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দিনের আলোতে ওই ভবনের পঞ্চম তলায় থাকা গোল্ডেন সন এক্সপোর্ট লিমিটেডের পলি সেকশন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তাই প্রশ্ন উঠছে, দুর্ঘটনার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টায় কেন ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হলো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কারখানার এক নারী শ্রমিক বলেন, আমরা বিকেল ৫টার দিকে কারখানা থেকে কাজ শেষ করে বের হই। কারখানার পাশেই আমার বাসা। ঘরে ফেরার প্রায় আধাঘণ্টা পর গার্মেন্টসে আগুন লাগার খবর পাই। পরে জেনেছি, ওই সময় কারখানায় ১১ শ্রমিক কাজ করছিলেন। ঘটনার পরপরই তারা ভবন থেকে নেমে আসেন। এরপর প্রায় এক ঘণ্টা পরে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে আসে।

এদিকে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের অপারেটর সোমবার সকালে জানান, ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারা রোববার সন্ধ্যা ৭টায় অগ্নিকাণ্ডের খবর পান। বেলাল আহমেদের মালিকানাধীন ১১তলা ভবনের পঞ্চম তলায় গোল্ডেন সান লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। পরবর্তীতে আগুন ষষ্ঠ তলায় জিএসএল পোশাক কারখানার ফেব্রিকস সেকশনেও ছড়িয়ে পড়ে।

তবে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি ও কারণ সম্পর্কে কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে পৌনে ৬টার মধ্যে আগুনের সূত্রপাত; প্রথম দিকে শুধু ধোঁয়া বের হলেও, পরবর্তীতে প্রায় সাড়ে নয় ঘণ্টাব্যাপী আগুনের তাণ্ডব চলতে থাকে। এ সময় কারখানার ভেতরে পুড়ে যাওয়া বিভিন্ন যন্ত্রাদি ও আসবাব জানালা দিয়ে নিচে পড়তে দেখা যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট প্রায় আট ঘণ্টা চেষ্টার পর ভোররাত ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

অসমর্থিত একটি সূত্রে জানা গেছে, কর্তৃপক্ষ আগুনে অন্তত ১০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। যদিও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনও পরিষ্কারভাবে কোনো কিছু বলা হয়নি।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘সন্ধা ৭টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট পাঠানো হয়। পরবর্তীতে আগুনের তীব্রতা বেড়ে গেলে আটটি ইউনিট নিয়ন্ত্রণে জোগ দেয়। ১১তলা ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় ছড়িয়ে পাড়া আগুন আট ঘণ্টা চেষ্টার পর নিয়ন্ত্রণে আসে। এখন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যায়নি। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কেও পরিষ্কারভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা অফিস থেকে একটি কমিটি ঘোষণা করা হবে। কমিটিতে কারা থাকবেন সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সোমবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হলেও এ নিয়ে গণমাধ্যমে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে দুর্ঘটনার বিষয়ে জানার জন্য সোমবার সকাল ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে সুনসান নীরবতা; ভবনের প্রধান ফটক বন্ধ। তখনও আশপাশে উৎসুক জনতার ভিড়। এ সময় প্রধান ফটকে গিয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলে প্রাথমিকভাবে অনুমতি মেলেনি। পরে সাংবাদিক পরিচয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মিললেও দুর্ঘটনাস্থলে যেতে দেয়া হয়নি।

কিছুক্ষণ পর জিএসএল পোশাক কারখানার কর্মী পরিচয় দিয়ে একজন এ প্রতিবেদককে তাদের এক ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। তারপরও কথা হয় তার সঙ্গে।

ওই ব্যবস্থাপক জানান, দুর্ঘটনাস্থলে এখন পর্যবেক্ষণ চলছে। এ কারণে গণমাধ্যমকে ওই এলাকায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অপেক্ষা করতে হবে। এ সময় ওই ব্যবস্থাপকের নাম জানতে চাইলে তিনি রূঢ় আচরণ করেন।

ঘটনাস্থলে যেতে না পেরে পরবর্তীতে এ প্রতিবেদক আশপাশের মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সন্ধ্যা ৭টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের কথা বলা হলেও আগুনের সূচনা হয় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে। প্রায় দুই ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি ঘটনাস্থলে এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা শুরু করে।

স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, আগেও পোশাক কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে কর্তৃপক্ষ বরাবর এসব বিষয় আড়ালের চেষ্টা করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমি বিকেল সাড়ে ৫টায় পাঁচ তলার গোল্ডেন সন কারখানা থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখি। এর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস আগুন নির্বাপণে যোগ দেয়। তবে এখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও মিডিয়াতে বলা হচ্ছে যে, আগুনের সূত্রপাত হয়েছে সন্ধ্যা ৭টার দিকে; যা সত্য নয়। এখানে মালিকপক্ষ বিষয়টিকে আড়ালের চেষ্টা করছেন বলে মনে করি। এছাড়া আগুন ধরার পরপরই সেখানে কর্মরত ১১ শ্রমিক বেরিয়ে আসেন, কেউ কোনোভাবে আহত হননি। মূলত পুরোদিনের কাজ শেষে শ্রমিকরা বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।