যানবাহন সঙ্কট ও যানজটে ভোগান্তির যাঁতাকলে যাত্রীরা, সংক্ষিপ্ত ছুটি নিয়ে ক্ষোভ

ঢাকা: আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর সারাদেশে উৎসব আনন্দের মধ্য দিয়ে পবিত্র ঈদুল আযহা পালিত হবে। ঈদের দিনসহ তিনদিন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সারাদেশে মুসলমানগণ পশু কোরবানি করবেন। তবে পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কোরবানি দেয়ার জন্য ও পরিবারের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগির জন্য আমজনতা ও বিভিন্ন মহল থেকে ১০দিনের ছুটি চাহিদা থাকলেও সরকারি ছুটি মিলেছে মাত্র ৬ দিন। মাঝে একদিন (১৫ সেপ্টেম্বর) সরকারি অফিস খোলা থাকলেও এদিন অনেকেই ছুটি নিয়েছেন। ফলে আরো তিনদিন ছুটি ভোগ করবেন সরকারি অনেক কর্মকর্তা। আবার ১০ দিনের ছুটির প্রয়োজনীয়তা থাকার পরও সরকার ছুটি না দেয়ায় অনেকে ১৫ সেপ্টেম্বর অফিস ফাঁকি দিবেন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।

প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ঢাকা থেকে মানুষ ছুটছেন গ্রাম-গঞ্জের দিকে। সরকারি অফিসগুলোতে বৃহস্পতিবার অনেকে কোনো মতে হাজিরা দিয়েই নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে ছুটতে শুরু করেন বাস, ট্রেন আর লঞ্চ টার্মিনালের দিকে। মানুষ ঢাকা ছাড়ার কারণে ক্রমেই ফাঁকা হচ্ছে ঢাকা। সাধারণ মানুষের কাছে নিরাপদ যানবাহন হচ্ছে ট্রেন। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই তাই রাজধানীর কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেল স্টেশনের দিকে মানুষের স্রোত।

আজ শুক্রবার সকালে কমলাপুর রেল স্ট্রেশন থেকে রাজশাহীগামী ধুমকেতু, খুলনাগামী সুন্দরবন এবং চট্টগ্রামগামী সোনারবাংলাসহ অন্যান্য ট্রেনগুলো মোটামুটি ঠিক সময়েই ছেড়ে যায়। এসব ট্রেনে ভেতরে জায়গা না পেয়ে ছাদেও চড়েন অনেকে।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার সিতাংশু চক্রবর্তী জানায়, এবার ট্রেনে কোনো শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে না। মোটামুটি সব ট্রেনই যথাসময়ে কমলাপুর থেকে ছাড়ছে। এদিকে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনালেও মানুষের স্রোত শুক্রবার সকাল থেকে। একই অবস্থা সদরঘাট লঞ্চঘাটেও। বাস টার্মিনাল ও লঞ্চঘাটে তিল ধারনের ঠাই নেই। বাসের ভেতরে জায়গা না পেয়ে অনেককে বাসের ছাদে এমনকি ট্রাকে চড়তেও দেখা গেছে।।

ভোগান্তি নিয়ে রাজধানী ছাড়ছে মানুষ:

কষ্ট ও বিড়ম্বনায় নাজেহাল হয়েই বাড়ি ফিরতে হয় ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষদের। এযেন তাদের নিয়তি। ব্যাতিক্রম হচ্ছে না এবারও। তাই হাজারো দুর্ভোগের ভোগান্তি নিয়েই রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নগরবাসী ছুটে যাচ্ছে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে।

আজ শুক্রবার রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায় ঘরমুখো মানুষের স্রোত। জীবনের ঝুঁকি, অতিরিক্ত ভাড়া, টিকিট ও পরিবহন সঙ্কট, শিডিউল বিপর্যয়, যানজট, দুর্ঘটনাসহ পদে পদে নানা সমস্যা নিয়ে ছুটছে মানুষ। কোনো কষ্টই যেন মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার থামাতে পারছে না। যাত্রাপথের সব বিড়ম্বনা উপেক্ষা করে সবাই তাই ছুটছে স্বজনের কাছে। এবার কোরবানির কাঙ্খিত ছুটি ১২ দিন না হয়ে ছয় দিন হওয়ায় বাড়ি ফিরতে তাড়াহুড়ো ও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে প্রত্যেক যাত্রীর চালচলনে। গত ইয়াওমুল খামীস (বৃহস্পতিবার) সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস থাকলেও অনেকে কোনো মতে হাজিরা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বাড়ি ছেড়েছেন।

গাবতলী থেকে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ে। গতকাল সকাল ৮ থেকেই ভিড় ছিল এখানে। হানিফ, সাকুরা, নাবিল, রয়েল ও ডিপজল পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, একটি বাসেও আসন খালি নেই।

হানিফ পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার শামিম ইসলাম জানান, তাদের বাসের টিকিট অনেক আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। একটি আসনও খালি ছিল না। বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে আসা সজল ইসলাম বলেন, ‘পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আগেই গ্রামে পাঠিয়েছি। আজ আমি বাড়ি যাচ্ছি। কিন্তু এখানে এসে দেখি বাসের শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। সকাল সাড়ে ৭টায় বাস ছাড়ার কথা কিন্তু এখন বাসে ৯টা বাজে কিন্তু বাসের দেখা পাচ্ছি না।’

বাগেরহাটগামী মোহাম্মদ সাব্বির হোসেন জানান, সকাল ৮টার সময় হানিফ পরিবহনের একটি বাসের টিকিট কেটেছেন প্রায় সপ্তাহখানেক আগে। তাই খুব সকাল সকাল কাউন্টারে এসে হাজির হয়েছেন। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন বাজে সকাল সাড়ে পৌনে ৯টা। কিন্তু বাস ছাড়াতো দূরের কথা, বাস এখনো টার্মিনালে এসেই পৌঁছায়নি। কখন বাস আসবে আর কখন বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাতে পারব, বুঝতে পারছি না।’

কথা হয় হানিফ পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজারের সঙ্গে। তিনি বলেন, যানজটের কারণে বাস আসতে দেরি করছে। তবে বাস আসার সঙ্গে সঙ্গেই আবার ছেড়ে যাবে। যানজট থাকায় বাস সময় মতো ছাড়া যাচ্ছে না।

গাবতলীতে যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তাদের কাঙ্খিত সেই বাসটি আসছে না। তাদের মনের ভেতরে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, কখন বাস আসবে আর কখন নিজ গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাবে তারা। গাবতলী বাস কাউন্টারে বাসের অপেক্ষায় থাকা মাহামুদ খান নামের একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি খুলনা যাওয়ার জন্য গত ১ সেপ্টেম্বর ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে এসে টিকিট সংগ্রহ করি। টিকিটটি তখন হাতে পেয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এবারের ঈদে বাড়িতে যেতে হয়তো খুব বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হবে না। কিন্তু এখন দেখি আমার সে ভাবনা ছিল ভুল।’

তিনি বলেন, ‘আজ সকাল ৭টায় গাড়ি ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন বাজে সোয়া ৯টা। কিন্তু এখন পর্যন্ত গাড়ির কোনো সন্ধান পাচ্ছি না। ভেবে পাচ্ছি না কী করবো।’ গাড়ি কখন আসবে এ ব্যাপারে কাউন্টারের কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাউন্টারে জিজ্ঞাসা করলে শুধু একটা কথাই বলে, যানজটের কারণে একটু দেরি হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে পড়বে। যাত্রীদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঈগল কাউন্টারের ম্যানেজার মোহাম্মদ হান্নান জানান, ঈদের জন্য আরিচা ফেরিঘাটে অতিমাত্রায় যানজট সৃষ্টি হওয়ার কারণে বাস আসতে পারছে না। তিনি বলেন, সাধারণত ঈদুল ফিতরের চেয়ে ঈদুল আজহার সময় যানজট বেশি হয়। কারণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কোরবানির গরু আসে রাজধানীতে। তাই এই সময়টা ফেরিতে বাস পারাপারে খুব সমস্যায় পড়তে হয়। তবে আসা করা যাচ্ছে, এই সমস্যা আজকের পর আর থাকবে না।

দীর্ঘ যানজট, চরম দুর্ভোগে যাত্রীরা:

গতকাল না’গঞ্জ সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা। শুক্রবার সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে জেলার সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে শিমরাইল, সোনারগাঁর কাঁচপুর, মদনপুর, মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা, রূপগঞ্জের যাত্রামুড়া ও ভুলতার গাউছিয়া পর্যন্ত এলাকায় গাড়ির জট দীর্ঘ হচ্ছে। যাত্রীরা বলছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই যানজটে পড়ে আছেন তারা। নারী ও শিশুরা পড়েছে বেশি ভোগান্তিতে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে এই যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। চালকদের অদক্ষতাও যানজটের জন্য দায়ী। ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট সাইফুল্লাহ বলেন, “ঢাকা থেকে যে গাড়িগুলো ছেড়ে আসে, ফোর লেনের (চার লেন) গাড়িগুলা আসে। এখানে আইসে, ব্রিজের কাছে আইসে গাড়িগুলা আর উঠতে পারে না।” সাইফুল্লাহ বলেন, “ব্রিজটা উঁচু। উঁচুর কারণে মালবাহী গাড়িগুলা, তারপর এই বাসগুলা উঠতে পারে না। ব্রিজ উঁচুর কারণে, তখন গাড়িগুলা এই ব্রিজের থেকে জ্যাম বেঁধে যায়। আর এই জ্যামটা তখন দীর্ঘ লাইন হয়ে যায়।” সাইফুল্লাহ আরো বলেন, “মেঘনা ব্রিজের কাছে টোল প্লাজায় একেকটা করে গাড়ি ছাড়ে। এ কারণে টোলপ্লাজায়ও গাড়ি জ্যাম হয়ে যাচ্ছে। তারপরও আমাদের ট্রাফিক থেকে সার্বক্ষণিক অ্যারেঞ্জমেন্ট (ব্যবস্থা) আছে।”

চাপ বেড়েছে সদরঘাটে

কুরবানির ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর সদরঘাটে ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে। রাজধানী থেকে নৌপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার এই ঘাট থেকে জুমুয়াবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ছেড়ে গেছে ২৬টি লঞ্চ; ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল প্রায় ৯০টি লঞ্চ।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) পরিবহন পরিদর্শক (টিআই) সৈয়দ মাহফুজুর রহমান বলেন, জুমুয়াবার সকালে ‘বেশ ভিড়’ ছিল। পরে বেলা বাড়লেও যাত্রীদের চাপ বাড়েনি।

বিআইডাব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন বলেন, বৃহস্পতিবার সারাদিন সদরঘাট থেকে ৯৪টি লঞ্চ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ছেড়ে যায়। জুমুয়াবার চাপ থাকায় এ সংখ্যা ১২০ ছাড়াতে পারে। তিনি জানান, বৃহস্পতি ও জুমুয়াবার অতিরিক্ত যাত্রী বা পন্টুনে লঞ্চ ভেড়ানো নিয়ে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি।

ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সদরঘাটে তিন শতাধিক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে বলে জানিয়েছেন কোতয়ালি থানার ওসি আবুল হাসান।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “ফুলবাড়িয়া থেকে যাত্রীদের আসতে যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয়, কোনো ধরনের হয়রানি যাতে না পোহাতে হয়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

সদরঘাটে পৌঁছতে যাত্রীদের যেন যানজটের মুখোমুখি হতে না হয় সেজন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে কোনো যানবাহন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

ঈদ উপলক্ষে সদরঘাটে ৩২টি সিসি ক্যামেরা বসানোর কথা জানিয়ে বিআইডাব্লিউটিএ কর্মকর্তা জয়নাল বলেন, কোনো লঞ্চ যাতে অতিরিক্ত যাত্রী নিতে না পরে সেজন্য দুজন ম্যাজিস্ট্রেট তদারকি করছেন।

ঈদের দুই দিন আগে সদরঘাট দিয়ে প্রতিদিন গড়ে দুই লাখ মানুষ রাজধানী ছাড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য এবারও দেড়শ লঞ্চ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

সকালে সদরঘাটে ঈদের যাত্রীদের চাপ থাকলেও লঞ্চ মালিক সমিতির উপদেষ্টা গোলাম কিবরিয়া টিপু দুপুরে বলেন, যাত্রীদের তেমন চাপ নেই। তবে পটুয়াখালীর কালাইয়া ও রাঙাবালির কিছু যাত্রী পাওয়া গেছে। বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে যাত্রীদের ঢল নামতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) সহকারী মহাব্যবস্থাপক বরকত উল্লাহ জানান, সদরঘাট থেকে সন্ধ্যা ৬টায় পিরোজপুরের হুলারহাট যাবে এমভি লেপচা এবং সাড়ে ৬টায় বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ যাবে এমভি বাঙালি।

বৃহস্পতিবারও স্টিমার দুটি হুলারহাট এবং মোড়েলগঞ্জ যায় বলে তিনি জানান।

যাত্রীর চাপ কেমন জানতে চাইলে বরকত উল্লাহ বলেন, স্টিমারে চাঁদপুর থেকে বেশি যাত্রী পাওয়া যায়। কারণ চট্টগ্রামসহ ওই অঞ্চলের যাত্রীরা চাঁদপুর হয়ে বরিশাল ও অন্যান্য জেলায় যায়। ঈদ উপলক্ষে আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্টিমার দুটি চলাচল করবে বলেও তিনি জানান।