বৃথা যাচ্ছে নদীভাঙন রোধে শত শত কোটি টাকা ব্যয়

চাঁদপুর সংবাদদাতা: মেঘনা নদী থেকে গত কয়েক বছর ধরে অবৈধভাবে যত্রযত্র বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যয় করলেও নদীভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতি হচ্ছে ইলিশসম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্যের। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। বালু উত্তোলন করে গুটিকয়েক ব্যক্তি হাতিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা।

নদীভাঙন ঠেকাতে বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর ও স্থানীয়রা বিরোধিতা করলেও বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে প্রভাবশালী ওই চক্রটি। সর্বশেষ গত শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) চাঁদপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভাতেও বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে বালু উত্তোলনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এক পর্যায়ে জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলে, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিআইডব্লিউটিএ’র তথ্য মতে চাঁদপুরের নদী থেকে যে প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তা সঠিক হচ্ছে না। এতে নদীর ক্ষতি হচ্ছে এবং নদীর জীববৈচিত্র্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের দিক থেকে বলা হয়েছে, এ প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলনের ফলে সরকার কোনও রাজস্ব পাচ্ছে না। সেলিম খান নামে এক ব্যক্তি আদালতে মামলা করে ২০১৫ সাল থেকে বালু উত্তোলন করছেন। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নদী প্রতিরক্ষা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক হিসেবে মামলার বিষয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। তা আদালতের এখতিয়ার। কিন্তু আমরা বিষয়টি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানাবো।’

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘একদিকে চার হাজার কোটি টাকার শহররক্ষা বাঁধ করার পরিকল্পনা, অপরদিকে মেঘনায় যত্রতত্র অবৈধ বালু উত্তোলন– এ দুটি একসঙ্গে চলতে পারে না। ২০১৫ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মেঘনার বালু উত্তোলনে সরকারের এক টাকাও লাভ হয়নি বরং ডুবোচর খননের নামে শতাধিক ড্রেজারের মাধ্যমে এলোমেলোভাবে বালু উত্তোলনের কারণে মেঘনার দুই পাড় ভাঙনের শিকার হচ্ছে। এ বালু উত্তোলন বন্ধ এবং নদী ও ইলিশ রক্ষায় যা যা করণীয় তা প্রশাসন করবে।’

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মুহম্মদ রেফাত জামিল বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে বালু উত্তোলন করছে তা তারা বৈজ্ঞানিকভাবে তুলছে না। তারা চাহিদাভিত্তিক বালু তুলছে। যেখানে বালু পাচ্ছে সেখান থেকেই তারা বালু তুলছে। নদীর গতিপথ আছে। এই গতিপথের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কোথায় পানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সেসব জায়গায় যদি ডুবোচর থাকে এবং কতটুকু গভীরতায় যেতে হবে সেটি একটি স্তরের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যারা বালু উত্তোলন করছে তারা সেটি মানছে না। তারা যেভাবে বালু উত্তোলন করছে তা নদীর জন্য ক্ষতিকর এবং ভাঙনের জন্য দায়ী।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাইড্রোগ্রাফিক স্টাডি করার পর ডুবোচর শনাক্ত করে এবং বিগত কয়েক বছরের নদীর গতি-প্রকৃতির ধারণা নিতে হবে। তারপর নদীর কোন ডুবোচর অপসারণ করতে হবে তা শনাক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে তা কতটুকু পর্যন্ত গভীর করা যাবে তাও নির্ধারণ করে দিতে হবে। এখানে সেগুলোর কিছুই করা হয়নি। ড্রেজিং শুধু টুকরো টুকরো জায়গায় করলে হবে না। বর্তমানে যারা নদীতে বালু তুলছে তারা তাদের প্রয়োজনের তাগিদে শুধু ব্যবসার উদ্দেশ্যে বালু উত্তোলন করছে। আদালতের আদেশ থাকায় প্রশাসন প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিতে পারছে না।’

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী বলেন, ‘গুটি কয়েক মানুষের কারণে নদী আমাদের গ্রাস করবে, ভাঙনের শিকার হবে নদীপাড়ের মানুষ, এমনকি ভাঙনের আতঙ্কে থাকবে শহরের মানুষ– এটি হতে পারে না। চাঁদপুরকে রক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছেন, আরও করবেন। কিন্তু নদীতে বালু সন্ত্রাসের কারণে নদীভাঙন ঠেকানো যাবে না– এটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানতে পারেন না। আমরা বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছি। কিন্তু এখনও বালু উত্তোলন বন্ধ করা হয়নি। নানা পন্থায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে একটি চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।’

বিআইডব্লিউটিএ’র উপপরিচালক কায়সারুল ইসলাম বলেন, ‘২০১০ সালের পর থেকে মাটি বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়ার সুযোগ নেই বিআইডব্লিউটিএ’র। নিয়মানুযায়ী যারা বালু উত্তোলন করবেন তারা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করবেন। এখানে সেটি হয়নি। কারণ, একটি পক্ষের আবেদনে আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বিআইডব্লিউটিএ’র হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করা হয়েছে। তারপর থেকেই সেলিম খান নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন।’

তিনি বলেন, ‘নদী ড্রেজিংয়ের নামে তৃতীয় পক্ষ যেভাবে বালু উত্তোলন করে সেটি নদীর জন্য ভালো না। জেলা প্রশাসকের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমরাও একমত পোষণ করি।’