বারোমাসি আম চাষে বিপ্লব

বারোমাসি আম চাষে বিপ্লব

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফল মানুষের প্রিয় খাদ্য। ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। শুধু মানুষ ও জীবজন্তুর নয়, ফলেরও রাজা আছে। ফলের রাজা হলো আম। শীত শেষে বাংলাদেশে আমগাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে।

আমের উৎপাদন, স্বাদ, রোগ-পোকার আক্রমণ আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে খুব। মুকুল আসার পর বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টি হলে মুকুল কালো হয়ে ঝরে পড়ে। বেশি তাপমাত্রা থাকলে এবং সেচ না দিলেও মুকুল ঝরে পড়ে। আবার রোগ ও পোকার আক্রমণেও আমের মুকুল ঝরে যায়।
আমগাছে প্রতি বছর বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে এই দুবার জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ এবং দুবার কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক এবং একবার গ্রোথ হরমোন এবং দু-তিনবার সেচ প্রয়োগ করলেই প্রত্যাশিত ফলন পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ আমচাষি এ কাজটি করতে চান না। অথচ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, পাবনা, মেহেরপুর ও সাতক্ষীরার চাষিরা জানেন কীভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুস্বাদু আম উৎপাদন করতে হয়। তারা জানেন আম উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল ও সংরক্ষণ পদ্ধতি।

একসময় আমের চাষ শুধু দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কয়েকটি জেলায়ই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আম্রপালি ও মল্লির মতো দুটি জাতের প্রবর্তনের ফলে আমের চাষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড় ও বরিশালেও দেখা যায় সুমিষ্ট আমের চাষ। যে ময়মনসিংহ, সিলেট, বগুড়া ও রংপুরের মতো বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় মোটেই আম চাষ হতো না, সে জেলাগুলোয়ও এখন আম পাওয়া যায় বসতবাড়ির আঙিনায়।

বাংলাদেশিরা বারো মাসই আমের স্বাদ উপভোগ করতে চায়। পৃথিবীর বহু দেশে বিশেষ করে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন ও কম্বোডিয়ায় বছরের বারো মাসেই আম উৎপাদিত হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ফল বিজ্ঞানীরাও বসে নেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাহাড়তলী কেন্দ্র সম্প্রতি বারি-১১ জাতের একটি বারোমাসি আমের জাত উদ্ভাবন করে সারা দেশের আমচাষিদের মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ জাতের আম বছরে তিনবার উৎপাদিত হয়। জাতটি বসতবাড়ির আঙিনা, ছাদবাগানের ড্রাম, রাস্তার ধার, অফিস-আদালত এবং শিক্ষাঙ্গনের অব্যবহৃত জায়গায়ও রোপণ করা যায়। গাছের আকৃতি ছোট। আম খেতে সুস্বাদু। একই গাছে মুকুল, গুটি ও পাকা আমের নজরকাড়া দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার আবুল কাশেম নামের এক ফলচাষি ও নার্সারি মালিক এ জাতের আমের চাষ করেন ২২ বিঘা জমিতে। আবুল কাশেম প্রথম ছয় বিঘা জমিতে ৬০০টি কাটিমন জাতের আমের চারা রোপণ করেন। চারা রোপণের দেড় বছর থেকেই গাছে আম ধরতে শুরু করে। সাড়ে চার বছরের একটি আমগাছে ১০০টির মতো আম পাওয়া যায়। চারটি আমের ওজন এক কেজি। মৌসুমে প্রতি কেজি আম বিক্রি হয় ২৫০ টাকা দরে। অ-মৌসুমে আরও বেশি দামে এই বারোমাসি আম বিক্রি হয়। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আমটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ আমে আঁশ নেই। পাকলে হলুদবর্ণ ধারণ করে। খেতে খুব মিষ্টি ও সুস্বাদু। আমের চামড়া কাগজের মতো পাতলা। ১০ থেকে ১৫ দিন স্বাভাবিক অবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা যায়।

এ আমের চাষপদ্ধতিও সহজ। তেমন পুঁজি বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হয় না। প্রতি বিঘা জমিতে আম চাষের জন্য ১০০টি চারা প্রয়োজন হয়। সারি থেকে সারি দূরত্ব দিতে হয় ১২ ফুট। প্রতি বিঘা জমিতে আম চাষের জন্য খরচ হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আম রোপণের ১ম বছর ১ বিঘা জমি থেকে ১ লাখ টাকার এবং ২য় বছরে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা এবং ৪র্থ বছর থেকে পুরোদমে ফলন পাওয়া যায়। প্রতি গাছে ১০০টি করে আম হলে ১০০টি গাছে ১০ হাজার আম ধরবে। প্রতিটি আমের ওজন ২০০ গ্রাম হলে এবং প্রতি কেজির দাম ২০০ টাকা হলে এক বিঘা জমির আম বিক্রি করে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব।

বর্তমানে দেশে বছরে ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়। যদিও বেসরকারি হিসেবে এর সংখ্যা দ্বিগুন থেকে তিনগুন।