রপ্তানী ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলার বাণিজ্য ঘাটতি ১৫.৫৫ বিলিয়ন ডলার

বিদায়ী অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার। সেই হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮২ কোটি ডলার। তার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৩৮৮ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম মাস অর্থাৎ জুলাইয়ে ৩৩১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। পোশাক রপ্তানির ওপর ভর করে পণ্য রপ্তানি আয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে রপ্তানি হয়েছে ৩৮৮ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের পণ্য। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) আজ মঙ্গলবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ এ তথ্য দিয়েছে।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে ১০ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়া পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে ৯০ লাখ ডলারের চামড়া, ২ কোটি ৪০ লাখ ডলারের চামড়াপণ্য ও ৭ কোটি ২৩ লাখ ডলারের চামড়ার জুতা রপ্তানি হয়েছে। সব মিলিয়ে চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তবে চামড়ার রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
চামড়া ও চামড়াপণ্যের পাশাপাশি পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে রপ্তানি হয়েছে ৭ কোটি ৪৮ লাখ ডলারের পাট ও পাটপণ্য। তার মধ্যে ৬৫ লাখ ডলারের কাঁচা পাট, ৫ কোটি ডলারের পাটের সুতা ও ৮৩ লাখ ডলারের পাটের বস্তা রপ্তানি হয়েছে। সব মিলিয়ে পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানি বেড়েছে দশমিক ৮৩ শতাংশ।

বাণিজ্য ঘাটতি ১৫.৫৫ বিলিয়ন ডলার:
আমদানিতে ধীরগতির পরও বড় বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছর। যার ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও রয়ে গেছে বড় ঘাটতি। অর্থবছর শেষ হওয়ার দেড় মাস পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশ ব্যাংক গত সোমবার বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৪০ লাখ (১৫.৫৫ বিলিয়ন) ডলার। ঘাটতির এই অংক ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম হলেও তার আগের ২০১৬-১৭ বছরের চেয়ে ৬৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।

লাগামহীন আমদানিতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি এক হাজার ৮১৭ কোটি ৮০ লাখ (১৮.১৮ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ৯৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তার আগের বছরের চেয়ে আমদানি বেড়েছিল ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ।

সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত বলেন, পদ্মা সেতু, মেট্টোরেলসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানির কারণে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় বেড়েছিল। এছাড়া বন্যায় ফসলের ক্ষতির কারণে চাল আমদানি বেড়েছিল। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছিল এ খাতের খরচ। কিন্তু গত অর্থবছরে এই সব খাতেই আমদানি ব্যয় কমেছে। আর সে কারণেই বাণিজ্য কমেছে বলে জানান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।
>> ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৫ হাজার ৫৪৩ কোটি ৯০ লাখ (৫৫.৪৪ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৯৯৪ কোটি ৫০ লাখ (৩৯.৯৪ বিলিয়ন) ডলার।
>> এ হিসাবে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
>> ঘাটতি কমেছে সেবা বাণিজ্যেও; ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৪২০ কোটি ডলার।

লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ৫.২৫ বিলিয়ন ডলার:
আমদানি কমায় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যও কমেছে। ৫২৫ কোটি ৪০ লাখ (৫.২৫ বিলিয়ন) ডলারের ঘাটতি নিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষ করেছে বাংলাদেশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল প্রায় দ্বিগুণ ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ বছরে ছিল ১৩৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। সাধারণভাবে কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সামগ্রিক লেনদেনে শেষ পর্যন্ত ১ কোটি ২০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই লেনদেনে ৮৫ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল। বিদেশি বিনিয়োগ ও সহায়তা ছাড়ের পরিমাণ বাড়ায় গত অর্থবছরে সরকারের আর্থিক হিসাবে ভালো ৫৬২ কোটি ৮০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত তৈরি হয়েছে। আগের বছরে এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল আরও বেশি; ৯০১ কোটি ১০ লাখ ডলার।

এফডিআই বেড়েছে ৩৭ শতাংশ:
গত অর্থবছরের সবমিলিয়ে ৪৫০ কোটি ১০ লাখ ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাংলাদেশে এসেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৩২৯ কোটি ডলার। এ হিসাবে গত অর্থবছরে এফডিআই প্রবাহ বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছে ২৫৪ কোটি ডলার। আগের বছরে এসেছিল ২৭৭ কোটি ০ লাখ ডলার। এ হিসাবে নিট এফডিআই বেড়েছে ৪২দশমিক ৮৬ শতাংশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।

পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে:
তবে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত অর্থবছরে এখানে ১৭ কোটি ২০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। আগের বছরে এসেছিল ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ৫৯৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ বছরের ছিল প্রায় সমান; ৫৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

৯০ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি:
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সঞ্চয়পত্র বিক্রির সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সবমিলিয়ে ৯০ হাজার ২৮০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এরমধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্তির কারণে আসল এবং সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৪০ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ হচ্ছে ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়।

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে অর্থবছর শুরু:
গত অর্থবছরের শেষ মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এর ঊর্ধ্বগতির মধ্য দিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাইয়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ, জুনে ছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। গত মাসে সব খাতে সার্বিকভাবেই মূল্যস্ফীতি আগের মাসের চেয়ে বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তৈরি মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ প্রতিবেদনের এসব তথ্য গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে সাংবাদিকদের তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, জুলাই মাসে দেশের অনেক অংশে বন্যা ও অতি বষ্টির কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে। এতে ফসলের ক্ষতির সঙ্গে কৃষি পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়েছে। “তাছাড়া ঈদ উপলক্ষে সাধারণ মানুষের কেনাকাটা বেড়ে যায়। গত মাসের শেষের দিকে ঈদের কেনাকাটা হয়েছে। এসব কারণে গত মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে বলে আমি মনে করি।”