ফরমালিনের অবাধ ব্যবহারঃ কঠোর আইন নাকি আইনের সঠিক প্রয়োগ?

গত বছর মার্চের মাঝামাঝি বাসায় এক ডজন কলা কিনে মাস খানেকের জন্য দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি কলাগুলো ডাইনিং টেবিলের এককোনায় পড়ে আছে – ঠিক যেমন তাজা কিনেছিলাম তেমনই। বন্ধ ঘরের ভ্যাপসা গরমেও কলাগুলোর এহেন তাজা চেহারা দেখে ভিতরেভিতরে আঁতকে উঠেছিলাম। আমার প্রিয় ফলের এই কি অবস্থা? ক’দিন আগে ফের একই রকম ঘটনা লক্ষ্য করলাম; ফ্রিজের বাইরে দুই সপ্তাহ যাবৎ লালশাখ তরতাজা পড়ে আছে! তাহলে কি ফরমালিনের অবাধ ব্যবহার এখনো বন্ধ হয়নি দেশের বাজারগুলোতে?

আসলে  ফলমূল ও সবজিতে ফরমালিনের অবাধ ব্যবহার বাংলাদেশ নতুন কোনো বিষয় নয় – এ নিয়ে অনেক  কথা-বার্তা, টকশো ও লেখা-লেখি হয়েছে, হচ্ছে। এইসব কথা-বার্তা ও লেখা-লেখির অধিকাংশ যা ইঙ্গিত করে তাহলো ফরমালিন ব্যবহারের শাস্তি বাড়ানো।

কিন্তু নিরাপদ খাদ্য আইন বিষয়ে সামান্য পড়াশুনা করার পর আমার মনে হয়েছে, শুধু উত্তরোত্তর শাস্তির বৃদ্ধি এবং কঠোর থেকে কঠোরর শাস্তির ভয় হয়ত আইন লঙ্ঘনকারীদেরকে আইন মানাতে যথেষ্ট নয়। বরং সহজ কিছু রেগুলেটোরী কৌশল প্রয়োগ করে বর্তমান আইনের মাধ্যমে ফলমূল ও সবজিতে ফরমালিন  বা অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিকের অবাধ প্রয়োগ বন্ধ করা সম্ভব।

প্রথমে আসা যাক, ফরমালিন প্রতিরোধে কঠোর শাস্তি দেয়ার বিষয়টি। শুধু কঠোর শাস্তিই যদি অপরাধ  নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হত তাহলে বাংলাদেশে বহু আগেই খাবারে ফরমালিন মেশানো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।

কারণ ১৯৫৯ সালের পিউর ফুড অর্ডিনেন্স (সদ্য বিলুপ্ত ) এর ‘৬ক’ ধারাতে খাদ্যে ফরমালিনের ব্যবহার  নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়েছিল। উক্ত ধারাতে ফরমালিন ব্যবহারের শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ তিন বছরের  জেল, দুই লক্ষ টাকা জরিমানা এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ারও  বিধান ছিল (ধারা ৫৮ দ্রষ্টব্য) ।

কিন্তু ওই আইনের বিলুপ্তিই প্রমান করে যে এতগুলো বছরেও আইনটি ফরমালিন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো অবদান রাখতে পারেনি। বলতে গেলে ফরমালিনের ব্যবহার বেড়েছে বৈ কমেনি।

এরপরে গত ২০১৩ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’ প্রনয়ন করা হয়। এই আইনের ২৩ ধারাতে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিনসহ অন্যান্য রাসায়নিক খাদ্যে ব্যবহার, মজুদ, বা বিক্রয়  নিষেধ করা হয়েছে এবং আইন অমান্য করলে এর শাস্তি হিসেবে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও বিশ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। যদিও এই আইনটির প্রয়োগ কতটুকু সফল হচ্ছে তা এখনই বলা সম্ভব নয়, তারপরও এ বছরের  গোড়ার দিকে নতুন করে আবার ‘ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫’ এর প্রনয়ন করা হয়।

ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইনের ২২ ধারাতে লাইসেন্স ব্যতীত ফরমালিন ব্যবহার করার জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা চার লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। উল্লেখ্য যে, এর  আগেও ‘ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯’ এর ২(২০)(গ) ধারাতে মানব দেহের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর দ্রব্য কোন খাদ্যপণ্যের সাথে যার মিশ্রণ কোন আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে (তখনকার প্রচলিত আইন ‘পিউর ফুড অর্ডিনেন্স ১৯৫৯’ এর ‘৬ক’ ধারাতে খাদ্যে ফরমালিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল), উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত কোন পণ্য বিক্রয় করা বা করতে প্রস্তাব করাকে ‘ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য’ বলে বিধান করা হয়েছে।

এবং এহেন ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কাজের জন্যে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর  কর্তৃক আইনের  ধারা ২৭(৩) ও ধারা ৭০ এর অধীনে লঙ্ঘনকারী দোষী ব্যক্তি, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জরিমানা আরোপ, ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল, ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে স্থগিতকরণ সম্পর্কিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহনের মত ব্যবস্থা রাখা  হয়। কিন্তু  কতটুকু  প্রয়োগ  হয়েছে  এই আইন ?

অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণ মাঝে মাঝে মোবাইল  কোর্ট নিয়ে মাঠে নামেন এবং  কিছু  ব্যবসায়ীকে  জরিমানা  করেন; তাদের নিয়মিত  কোনো কার্যক্রম সাধারণ ভোক্তাগণ দেখতে পান  না। অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের  দ্বারা প্রশাসনিকভাবে আইনের ক্ষুদ্র  প্রয়োগের বাইরেও ভোক্তা অধিকার আইনের ৪২ ধারাতে মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোন দ্রব্য খাদ্যপন্যের সাথে মেশানোর জন্য তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডি হওয়ার মত শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কয়জন খাদ্যে  ফরমালিন ব্যবহারকারীর এই শাস্তি  হয়েছে ? খোঁজ  নিয়ে চূড়ান্ত নিস্পত্তি হওয়া মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো খাদ্য  ব্যবসায়ীর সন্ধান পাওয়া যায়নি।

যাই  হোক, সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, খাদ্যে ফরমালিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে বর্তমানে দেশে একই  সাথে তিনটি আইন প্রচলিত  রয়েছে। স্বভাবতই একজন  সাধারণ ভোক্তার মনে কিছু প্রশ্ন  জাগে। যেমন- একটি অপরাধ (খাদ্যে ফরমালিনের ব্যবহার)  নিয়ন্ত্রণ  করার  জন্য  তিন তিনটি  আইনের  আদৌ  কোনো দরকার আছে কি ? যদিও বা থাকে, তাহলে সেই তিনটি  আইনের প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় আছে কি ?

গবেষণা কর্মের অংশ হিসেবে বাজার ঘুরে আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা  করেছি। প্রথমত, শুধু ফরমালিন নিয়ন্ত্রণে তিনটি আইন মোটেই জরুরী নয়। দ্বিতীয়ত, তিনটি আইনের প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর  মধ্যে দৃশ্যমান কোনো সমন্বয় খুঁজে এখনো দৃশ্যমান নয়। তাই সামগ্রিক অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যায়, ফরমালিন ব্যবসায়ী  বা ফল ও সবজিতে ফরমালিন ব্যবহারকারীরা ভেবেই নিয়েছে যে  আইনের সংখ্যা যত  বেশিই  হোক না কেন অথবা সেইসব আইনের বিধান যত কঠিনই হোক না কেন এই দেশে আসলে এর বাস্তবায়ন যথারীতি  দুর্বলই  থাকবে। সেকারণেই হয়ত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বেশি আইন প্রয়োগ বা কঠোর শাস্তি দেয়ার চাইতে কোনো আইনের নির্দিষ্ট ও কঠোর ‘প্রয়োগ’ বা ‘বাস্তবায়ন’কে গুরুত্ব দেয়া হয় ।

এই লেখাতে আমি আপাতত বর্তমান আইনের সংস্কার করা নিয়ে কোনো কথা বলবো না কারণ সেটি একটি দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। বরং বর্তমান আইনগুলোর সাধারণ বাস্তবায়ন পদ্ধতির সাথে আর  কি কি কৌশল যোগ করলে আইনের সুফল পাওয়া সম্ভব সেরকম দুই-তিনটি বিষয় তুলে ধরতে চাই।

প্রথমত, বাংলাদেশে যারা আইন মেনে চলেন এবং খাদ্যে ফরমালিন ব্যবহার করেন না, তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়ার বা উৎসাহিত করার কোনো রীতি নেই। যে কারণে সাময়িকভাবে কেউ আইন মানলেও কিছুদিন পর আগ্রহ হারিয়ে আবার পুরনো অন্ধকার রাস্তায় পা বাড়ান। তাই, যেসব ব্যবসায়ীরা আইন মেনে  চলেন  এবং খাদ্যে বা ফলমূলে ফরমালিন ব্যবহার করেন না তাদেরকে সনাক্ত করতে হবে এবং দেরকে  উৎসাহিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সেজন্য রেডিও, টেলিভিশন ও শীর্ষ দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আইন মান্যকারী ব্যবসায়ীদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করতে হবে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ সাধারণ ভোক্তাদেরকে সেইসব জায়গা থেকে ফরমালিনমুক্ত খাবার, ফল বা সবজি কিনতে উৎসাহিত করতে হবে।

নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে ২০১৩ সালে আমেরিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে আমি দেখিয়েছি যে, এই পদ্ধতি অনেকাংশেই সফল হবে এবং সিংহভাগ ভোক্তারাই ভেজাল ও ফরমালিন মুক্ত খাবার কিনতে আগ্রহী  হবেন। অধিকন্তু এতে করে ভালো ও সৎ ব্যবসায়ীগণ উত্সাহিত হবেন এবং অধিক বিক্রির ফলে তাদের ব্যবসায়ও  লাভের যোগান বাড়বে।

দ্বিতীয়ত: ভোক্তা-অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে জেলের শাস্তির চাইতে বড় অঙ্কের সিভিল পেনাল্টি  বা  জরিমানা বেশি কার্যকর বলে বিভিন্ন একাডেমিক রিসার্চে উঠে এসেছে। তাই বর্তমান আইনে যদি রেগুলেটরী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপরাধ্স্থলে মোবাইল কোর্টের অধীনে বড় অঙ্কের জরিমানা করার অনুমুতি  দেয়া হয় তাহলে অপরাধের পরিমান কমতে পারে। এর  কারণ  দুটি। এক, আইনের শাস্তির বিধানগুলো  অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অপরাধ আইনের ‘মেনস রিয়া’ (দোষী মন) বা ‘একটাস রিয়া’র (অপরাধ কার্য)  দুর্বলতার কারণে আদালতে টিকতে পারে না।

অধিকিন্তু অসৎ ব্যবসায়ীরা বড় বড় আইনজীবিদের দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞতাসম্ম্পন্ন সরকারি আইনজীবিদের সহজে হারিয়ে দেন। আর বিচারের চেয়ারে বসে জজ সাহেবদেরকে অসহায়ভাবে সাধারণ ভোক্তাদের নিপীড়িত হতে দেখতে হয়।

দুই, গবেষণায় দেখা গেছে ব্যবসায়ীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লাভের লোভে পড়ে ফলমূল বা সবজিতে ফরমালিন মেশান। তাই এমন যদি হয় যে, ফরমালিন ব্যবহার করে লাভ হয় এক লক্ষ টাকা  কিন্তু ধরা পড়লে ঘটনাস্থলে জরিমানা হবে দুই লক্ষ টাকা – তাহলে অপরাধ প্রবনতা অনেকাংশে কমে আসবে।

তৃতীয়ত, বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে নিয়মিত সমন্বয় বৈঠক এর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সব জায়গাতে সমানভাবে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় ।

সর্বোপরি, আইনের  বিধি-বিধান সম্পর্কে জনসচেতনতা  বাড়িয়ে তুলতে হবে। ফরমালিন ব্যবহারের  ফলে  কি কি সমস্যা  হতে পারে বা হচ্ছে  তা আজকাল  মিডিয়ার  কল্যাণে আমরা  অনেকেই জানি। তাই এখনই  যদি আইনের  সঠিক  ও বাস্তবসম্মত প্রয়োগ  করে ফরমালিনের  ব্যবহার বন্ধ  করা না যায় তাহলে একদিন হয়ত জাতি হিসেবে আমাদেরকে করুন পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।