পুলিশ সোর্সের নির্যাতনে দরিদ্র চা বিক্রেতার মৃত্যু

ঢাকা : পোড়া শরীরের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন হতদরিদ্র চা বিক্রেতা বাবুল মাতুব্বর। চাঁদার টাকা না দেয়ায় পুলিশ সোর্সের লাঠির আঘাতে তেলের চুলা বিস্ফোরণে দ্বগ্ধ হয়ে প্রাণ দিলেন ফুটপাতের এ চা-দোকানি। গত বুধবার রাতে দ্বগ্ধ হওয়া এ দোকানি বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান। চিকিৎসকরা মৃত্যু নিশ্চিত করার পর হাসপাতালের করিডোরে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখা যায় বাবুল মাতুব্বরের স্বজনদের। ছেলে রাজু বলছিলেন, ‘পুলিশ আমার বাপটারে মাইরা ফালাইছে। এখন আমাদের কী হবে?’

পাঁচ ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সৎভাবে বেঁচে থাকার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হতো বাবুল মাতুব্বরকে। বড় ছেলে রাজু কখনো সবজি বিক্রি, কখনো রিকশা চালিয়ে কিংবা বাবার দেয়া চা দোকানে সময় দিয়ে চেষ্টা করতো সংসারে বাবার বোঝা লাঘব করার। বাপ-বেটার রোজগারে কোনমতে দিন কাটছিল ৭ সদস্যের এই পরিবারটির।

টানাপোড়েন থাকলেও সুখের কমতি ছিল না বাবুল মাতুব্বরের সংসারে। সৎভাবে থাকার জন্য বাবা হিসেবে সবসময় উপদেশ দিতেন সন্তানদের। কিন্তু এই সুখের সংসারে দেখা দেয় কালো মেঘের ছায়া। প্রতিবেশী মাদক ব্যবসায়ীর কালো ছায়া থেকে সম্মানের সাথে পরিবারকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি। এজন্য পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগও করেন। কিন্তু সেটিই কাল হলো তার। প্রতিকারতো পেলেনই না বরং পুলিশ-মাদক ব্যবসায়ীর সখ্যতার আগুনে পুড়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণটাই হারাতে হলো বাবুল মাতুব্বরকে।

পরিবার নিয়ে বাবুল মাতুব্বর বসবাস করতেন মিরপুর শাহ আলী থানাধীন গুদারাঘাটের ৭ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়িতে। তাদের পাশের কক্ষেই ভাড়া থাকেন পারুলী নামে আরেক নারী।

বাবুলের ছেলে রাজু বলেন, পারুলী (পারুল) একজন গাঁজা বিক্রেতা। তার ঘরে প্রায় সারাক্ষণই  মাদকাসক্তদের আসা-যাওয়া লেগে থাকতো। তবে প্রায়ই গাঁজা কেনার জন্য লোকজন ভুল করে তাদের বাসায়  ঢুকে পড়তো। এতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো তাদের। বহুবার পারুলীর সাথে এ নিয়ে তাদের ঝগড়া হয়েছে। পারুলী উল্টো তাদেরকে বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিত। নিরূপায় হয়ে মাস ছয়েক আগে পুলিশের মিরপুর জোনের উপ-কমিশনারের (ডিসি) কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেন বাবুল মাতুব্বর। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডিসি শাহ আলী থানার ওসিকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি পারুলীর মাদক বিক্রি। নিয়মিতই তার ঘরে আসা-যাওয়া লেগে থাকতো মাদকসেবীদের।

রাজু অভিযোগ করেন, শাহ-আলী থানা পুলিশের সাথে পারুলীর সখ্যতা থাকায় সে নির্বিঘ্নে এই ব্যবসা চালাচ্ছিল। তাই ডিসি’র কাছে অভিযোগ দেয়ার পরও বন্ধ ছিল না তার এই অবৈধ ব্যবসা।

রাজু জানান, বুধবার দুপুর একটার দিকে শাহ আলী থানার এসআই শ্রীধাম চন্দ্র হাওলাদার, সোর্স দেলোয়ার এবং ৪ কনস্টেবল গুদারাঘাট কিংশুক বহুমুখী সমবায় সমিতির সামনে তার বাবা বাবুলের চা দোকানের সামনে আসে। এসআই বাবুলকে এখানে চা দোকান বসানোর জন্য গালমন্দ করে চলে যায়। রাত ১০টার দিকে এসআই শ্রীধাম, সোর্স দেলোয়ারসহ ২ কনস্টেবল একটি মাইক্রোবাস নিয়ে আবারো তাদের চা দোকানের সামনে আসে। এরপর এখানে চা দোকান বসাতে হলে পুলিশকে টাকা দিতে হবে বলে ধমকাতে থাকে সোর্স দেলোয়ার । বাবুল এই কথার প্রতিবাদ করে বলে, ‘কেন আমি টাকা দিব?’ তাদের মধ্যে এই ধরনের কথপোকথনের সময় এসআই শ্রীধাম সহ দুই কনস্টেবল অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তিও হয়। কথপোকথনের একপর্যায়ে সোর্স দেলোয়ার জ্বলন্ত চুলায় লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করলে তেল ছিটকে আগুন ধরে যায় বাবুল মাতুব্বরের শরীরে।

বাবুলের পুত্রবধূ ও রাজুর স্ত্রী মনি আক্তার জানান, ধস্তাধস্তির সময় একজনের গায়ে তিনি পুলিশের পোশাক দেখেছেন। আগুন লাগার পর তারা মাইক্রোবাসটি নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে যান।

এদিকে গুরুতর আহত অবস্থায় বাবুলকে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে নিয়ে এলে বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তার শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল বলে জানান বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।

ঘটনার পর রাত দেড়টার দিকে বাবুলের মেয়ে রোকসানা বাদী হয়ে শাহ-আলী থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় পারুল, দেলোয়ার, আইয়ুব আলী, রবিন, শংকর, দুলাল হাওলাদার ও পারভীনসহ অজ্ঞাত ২/৩ জনকে। মামলা দায়েরের পর পারুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বলে জানান শাহ আলী থানার এসআই মোরশেদ।

এদিকে এ ঘটনা সম্পর্কে পুলিশের মিরপুর জোনের  ডিসি কাইয়ুমুজ্জামান খান বলেন, পুলিশ  সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দেয়নি। আর মৌখিক অভিযোগ দিলেই তো শুধু হবে না। আমাদের কাছে ডকুমেন্টস থাকতে হবে। তবে এ ঘটনার সাথে যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

অন্যদিকে শাহ আলী থানার ওসি এ কে এম শাহীন মন্ডল  জানান, আগুন লাগার সংবাদ জানার পর পুলিশ সেখানে গিয়েছে। আর বাবুল চা বিক্রির পাশাপাশি  গাঁজাও বিক্রি করতো বলে আমাদের কাছে তথ্য ছিল।

শাহ আলী থানার এসআই শ্রীধাম চন্দ্র হাওলাদারকে বাবুলের ছেলে রাজুর অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমি ওই এলাকায় ডিউটিতে ছিলাম এটা সত্য, কিন্তু আমি ঘটনাস্থলে ওইসময় ছিলাম না। তবে তিনি রাতে মাইক্রোবাস নিয়ে ডিউটি করেছেন বলে জানান। বাবুলের পরিবার রাতে থানায় এতে তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছে বলে জানান এসআই শ্রীধাম।

এদিকে দুপুরে বাবুলের মৃত্যুর পর বিকেলে এ ঘটনায় পুলিশের দুই এসআই  নেয়াজ উদ্দিন মোল্লা ও মমিনুর রহমান, এএসআই দেবেন্দ্রনাথ এবং কন্সটেবল জসিম উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান ডিএমপি’র ডিসি (মিরপুর)  কাইয়ুমুজ্জামান খান।

এ বছরের শুরুতে রাজধানির তিন থানায় সরকারি দুই কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীকে লাঞ্ছনার অভিযোগ উঠে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। প্রথমে অস্বীকার করলেও তথ্য প্রমাণে ফেঁসে গিয়ে বাহিনির সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

বাবুল মাতুব্বরের ক্ষেত্রে নির্যাতনের নিত্যকার অভিযোগ ছাড়িয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। মিরপুর থানার পুলিশ এবার সরাসরি অস্বীকার না করে বলেছে, এ ঘটনায় তারা নয় ‘সোর্স’ জড়িত।একই নিয়মে দুই তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।