পাঁচ বছরেও কমেনি ঋণ খেলাপি

আদালতেই আটকা ব্যাংকের পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: আড়াই লাখ খেলাপির পকেটে দেড় লাখ কোটি টাকা ।ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বিপজ্জনক হারে। বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েও খেলাপির লাগাম টানা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কখনো ব্যাংকারদের সঙ্গে যোজসাজশে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। পরে তিনি ঋণখেলাপিতে পরিণত হচ্ছেন। শাস্তি না হওয়ায় ঋণখেলাপির সংখ্যা ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ হু হু করে বাড়ছে। ঋণখেলাপিদের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি)। ব্যাংকগুলো প্রতিমাসের ঋণসহ খেলাপির তথ্য পরবর্তী মাসের ২০ তারিখের মধ্য সিআইবিতে প্রেরণ করে।

সিআইবির সর্বশেষ তথ্য মতে, গত বছরের নভেম্বরে ঋণখেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৩৫১ জন। তাদের কাছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা আটকে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২০১৩ সালে ঋণখেলাপির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার ৭৫৮ জন। এ হিসাবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আলোচ্য বছরে নতুন করে খেলাপি হয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৯৩ জন ঋণগ্রহীতা।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের জাতীয় সংসদের প্রকাশিত তালিকা তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালের জুনে দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ জন। অর্থাৎ মাত্র ৫ মাসের ব্যবধানে খেলাপি হন ৩৭ হাজার ৬৯৩ জন ঋণগ্রহীতা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদের দুবার শীর্ষ ১০০ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছেন। তাদের কাছ থেকে কোনোভাবেই ব্যাংকগুলো অর্থ আদায় করতে পারছে না। তবে এ তালিকায় বড় খেলাপিদের নাম নেই। বড় খেলাপিরা আদালতে রিট করে ঋণখেলাপির ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন। তারা ব্যাংকের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে তা ফেরত না দিলেও ঋণখেলাপির তালিকায় তাদের নাম নেই।

প্রতিনিয়ত খেলাপি হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। আগে যারা খেলাপি হয়েছেন তাদের ঋণ পরিণত হয়েছে আদায় অযোগ্য কুঋণে। এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখার কারণে ব্যাংকগুলোর প্রায় দ্বিগুণ টাকা আটকে গেছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া এসব আমানতের বিপরীতে নিয়মিত মূল টাকাসহ সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া ঋণ ব্যবস্থাপনা, আইনি লড়াই চালানো ও জামানত পাহারা দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে আরও অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতি এখন ব্যাংকের জন্য বড় বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ ছাড়া ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের কয়েকটি জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০১২ সালে হলমার্ক গ্রুপের নামে সোনালী ব্যাংকসহ ২৬টি ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা, ২০১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রপের নামে পাঁচটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, একই বছরে বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা, ২০১৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকসহ একটি সরকারি ব্যাংক থেকে সানমুন গ্রুপ ১ হাজার ৬০০ টাকা, ২০১৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ফারমার্স ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে জনতা ব্যাংক থেকে ক্রিসেন্ট লেদারের নামে ৫ হাজার কোটি ও অ্যাননটেক্সের নামে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণের অধিকাংশ অর্থই বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য গ্রাহক ও ব্যাংকার উভয়ে দায়ী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের শিথিলতার কারণেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে জড়িত ব্যাংকারদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতে ঋণ শ্রেণি-খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত এবং সেগুলো আদায় করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। ঋণের টাকা আদায়ের জন্য বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে ঋণখেলাপি আর না বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পক্ষ থেকে। তিনি ব্যাংকের মালিক ও এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করে খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না বলে ঘোষণা করেছেন।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সবার আগে আমরাই খেলাপি ঋণ কমাতে চাই। আমাদের নিজেদের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। তবে এ মুহূর্তে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী বিচার কার্যক্রম। বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। আবার পর্যাপ্ত বিচারক নেই। ঋণখেলাপি হলে কোনো শাস্তি হয় না। এ বাস্তবতায় অনেকেই ঋণের টাকা ইচ্ছাকৃতভাবে ফেরত দেন না। বিচারে কিছু লোকের শাস্তি হলে সহজে কেউ ঋণখেলাপি হতে চাইবে না। এ ছাড়া রিটের মাধ্যমে স্থগিতাদেশ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পৃথক বেঞ্চ গঠন করা প্রয়োজন।

এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে ১০টি জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকিং খাত থেকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।