থামছে না যুদ্ধ-যুদ্ধ,অঞ্চলগত অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির ঝুঁকি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:আটক পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে ভারতে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় শুক্রবার পাকিস্তান বলেছিল, শান্তি স্থাপনের বার্তা হিসেবে তাকে ফেরত পাঠানো হলো। ধারণা করা হচ্ছিলো, দুই দেশের চলমান উত্তেজনা নিরসনে ইসলামাবাদের এই পদক্ষেপ ভূমিকা রাখবে। তবে সেই আশাবাদ গুলিবিদ্ধ হয়েছে একইদিন মধ্যরাতে। এদিন কাশ্মির সীমান্তে আবারও পরস্পরের বিরুদ্ধে গোলাবর্ষণ করেছে ভারত-পাকিস্তান। রাষ্ট্রনায়কদের সেই যুদ্ধান্মদনার বলি হয়েছে দুই দেশের সাধারণ মানুষ। শনিবার আবারও দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের খবর মিলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমের পাতায় উঠে এসেছে পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনাজনিত উদ্বেগের খবর। কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম বলছে সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে চিরবৈরী দুই দেশ। তবে বিশ্লেষকদের ভিন্নমত রয়েছে। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে সামরিক সংঘাতের চেয়ে প্রচারণা আর কূটনীতিতেই বেশি মনোযোগ তাদের। বিশ্লষকরা মনে করছেন, চলমান উত্তেজনা দীর্ঘমেয়াদে গিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলার পাশাপাশি জঙ্গি তৎপরতাকে বিস্তৃত করবে। সবমিলে দুই পক্ষের উত্তেজনায় অঞ্চলগত অস্থিতিশীলতা আরও প্রকট হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা তাদের। সংলাপেই সংকটের সমাধান দেখছেন তারা।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মিরের পুলওয়ামায় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জঙ্গি হামলার জেরে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢুকে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। পরদিন বুধবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে নিজেদের সীমানায় দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত ও এক পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান। ’৭১ পরবর্তী সময়ে প্রথমবারের মতো পাল্টাপাল্টি বিমান হামলায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনে সদিচ্ছার প্রতীক হিসেবে শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। শুক্রবার রাত নয়টার কিছু পরে ওই পাইলটকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করে পাকিস্তান।
পাকিস্তান আটক পাইলট অভিনন্দনকে ফেরত দেওয়ার কারণ হিসেবে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছিল শুরু থেকেই। তবে ভারতের দাবি ছিল, জেনেভা কনভেনশনের ভয়ে পাকিস্তান বাধ্য হয়ে তাকে ফেরত দিতে সম্মত হয়েছে। এদিকে কূটনৈতিক সূত্রে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিয়েছিল, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ওই পাইলটকে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসলামাবাদ। কারও কারও মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল যে সংঘাত নিরসনে অভিনন্দনের মুক্তির ঘটনা ভূমিকা রাখবে। তবে অভিনন্দনকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর শুক্রবার রাতে দুই দেশই কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরস্পরের বিরুদ্ধে গোলাবর্ষণ করেছে।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে শুক্রবার রাতে পাকিস্তানের ছোঁড়া গোলার আঘাতে দুই শিশু ও এক নারীসহ একই পরিবারের তিনজন নিহত ও অনেকে আহত হয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের দাবি ভারতীয় গোলার আঘাতে কাশ্মিরের দুই জন নিহত ও তিন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছে। বেসামরিক মানুষদের ওপর গোলাবর্ষণরত ভারতীয় বাহিনীর চেকপোস্টকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে গিয়ে দুই সেনা সদস্য নিহত হয়েছে বলেও দাবি করেছে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ। পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণের খবরে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগের খবর উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।
রুশ সংবাদমাধ্যম আরটি তাদের শিরোনামে লিখেছে ‘উত্তেজনা প্রশমন বিলম্বিত: কাশ্মির সীমান্তে ভারত-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণ’। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ইউকে লিখেছে, কাশ্মিরে আবারও গোলাগুলিতে বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ায় ফিরছে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা। দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশির নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর উত্তেজনা বৃদ্ধির খবর সামনে এনে বৃটিশ সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণের যথাযথ জবাব দেওয়ার কথা জানিয়েছে ভারতীয় বাহিনী।

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে লিখেছে, যুদ্ধের কিনার থেকে ফেরার বদলে পরস্পরের বিরুদ্ধে গোলাবর্ষণ করেছে দুই দেশ। মার্কিন সংবাদমাধ্যম কলোরাডো ডেইলিতে লেখা এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মিরে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার জেরে পাল্টাপাল্টি বিমান হামলার পর ভারত ও পাকিস্তান বড় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনোমিক টাইমস-এর শনিবারের এক শিরোনাম: ‘পাল্টা উপহার হবে না: পাকিস্তানের প্রতি কঠোর থাকবে ভারত’। সংবাদের ভাষ্য: অভিনন্দন বর্তমানের মুক্তি প্রশ্নে পরাশক্তিগুলোর পর্দার আড়ালের কূটনৈতিক পদক্ষেপ আর প্রকাশ্য শান্তির আহ্বান সত্ত্বেও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী অবকাঠামো এবং সন্ত্রাসী হামলার মূল হোতাদের বিরুদ্ধে চাপ অব্যাহত রাখবে ভারত।

এশিয়ান রিভিউ পত্রিকায় শ্রীরাম চাউলিয়া লিখেছেন, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি তৎপরতা যে বৈশ্বের জন্য একটা নিরাপত্তা হুমকি, ভারতের সে সংক্রান্ত প্রচারণা জঙ্গিবাদবিরোধী বিশ্ব জনমতের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। চাউলিয়া লিখেছেন, ‘ভারতীয় বৈমানিককে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দ্রুত নেওয়া পদক্ষেপ ইসলামাবাদকে দীর্ঘ সময় পর দিল্লির সঙ্গে চলা সংঘাতে একটি কূটনৈতিক বিজয় এনে দিয়েছে, যা সচরাচর ঘটে না। শুক্রবার ওই বৈমানিককে ফেরত দেওয়ার পেছেন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের কূটনৈতিক চাপ কার্যকর থাকলেও, এটা দৃশ্যত ইতিবাচক। বিশ্ব জনমতের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি মনে করছেন, এই সংঘাত শুধুমাত্র কাশ্মিরের এলাকাগত নিয়ন্ত্রণ, জাতীয়তাবাদী আদর্শের সংঘাত বা সামরিক দ্বৈরথের বিষয় নয়, বরং তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি পাওয়ার প্রতিযোগিতাও।

বিমান হামলা চালানো, বোমাবর্ষণ করা এবং অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করার অভিযোগ তারা একে অপরের বিরুদ্ধে করছে, সেসব আদতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য দিল্লি ও ইসলামাবাদের কূটনৈতিক প্রচারণা। সেই কূটনৈতিক যুদ্ধে ভারতকেই এগিয়ে রাখছেন তিনি। বলছেন, ‘ইসলামাবাদ উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কিছু সুফল পেলেও ‘পিআর গেমে’ ভারত অনেক বেশি এগিয়ে। গণতান্ত্রিক দেশ ও ক্রমে উন্নতি করতে থাকা অর্থনীতি হিসেবে দিল্লির কূটনৈতিক অবস্থান অনেক বেশি সংহত।’
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শান্তি আলোচনার প্রস্তাবে কোনও আগ্রহ দেখায়নি ভারত। পাকিস্তান শান্তির বার্তার সমান্তরালে পাল্টা আক্রমণ-হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। পারমাণবিক হামলার ইঙ্গিত দিতেও ছাড়েনি দুই পক্ষ। কানাডাভিত্তিক গ্লোবাল রিসার্চরে এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এটা মনে রাখা জরুরি যে উভয় পক্ষের সরকার ও সংবাদমাধ্যমগুলো এই সংঘাতের তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো, উত্তেজনা বৃদ্ধিতে বিরোধী পক্ষের দোষ সামনে নিয়ে আসা এবং নিজেদের পক্ষের হতাহতের সংখ্যা ও নিজেদের দায়-দায়িত্বের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে দুই পক্ষই। বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ‘২৮ ফেব্রুয়ারি নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনা বাড়তে দেখা গেছে। উভয় পক্ষই সীমান্তে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে।

গ্লোবাল রিসার্চের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই পরিস্থিতির কারণে অঞ্চলটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার আরও অবনতি হবে যার কারণে ভারত-পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা তৎপরতা বাড়িয়ে দেবে। ভারত পাকিস্তানের মধ্যে ‘পরোক্ষ যুদ্ধের’ মতো যে সংঘাত এখন চলছে তাতে অঞ্চলটিতে থাকা জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে বিদ্যমান চরমপন্থী আদর্শ আরও বেশি বৃদ্ধি পাবে। গ্লোবাল রিসার্চ বলছে, ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে, জঙ্গি দমনের নামে সার্বভৌমত্বকে উপেক্ষা করে সামরিক হামলা চালানোর নিন্দনীয় নীতি নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে। এই নীতি কোনও দেশের জন্য চরমপন্থীদের প্রশ্রয় দেওয়াটা বৈধ করে তোলে না। কিন্তু এই নীতিই বারবার উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে দায়ি কারণগুলোর একটি। একই রকম পরিস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় সিরিয়া ও লেবাননে, যেখানে ইসরায়েল অবৈধভাবে বিমান হামলা চালায়। আর তারপর ভাবতে বসে, কেন ওই হামলার পরও অঞ্চলটিতে উত্তেজনা প্রশমিত হলো না।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত উইড্রো উইলসন স্কুল অব পাবলিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ‘প্রোগ্রাম অন সায়েন্স অ্যান্ড গ্লোবাল সিকিউরিটির’ সমন্বয়ক জিয়া মিয়া অংশ নিয়েছিলেন ‘ডেমোক্রেসি নাও’ অনুষ্ঠানে। সংশাপেই সংকটের সমাধান দেখছেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এই গবেষক। বুধবার সকালে ডেমোক্র্যাসি নাউকে তিনি বলেছেন্, আবার অস্ত্রবিরতি কার্যকর করার বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। দুই পক্ষকেই সংযত করতে হবে। বিমান হামলা ও শেলিং বন্ধ করাতে হবে। তারপর সর্বোচ্চ সদিচ্ছা নিয়ে বসতে হবে আলোচনায়।