জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে সরকার: রামপাল প্রসঙ্গে খালেদা


ঢাকা: রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, “জনমত উপেক্ষা করে দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত জনগণের উপর জবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দিচ্ছে স্বৈরাচারী সরকার।”

তিনি বলেন, “সুন্দরবনের এত কাছে স্থাপিত কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনিবার্য অশুভ ও মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়ার সব প্রমাণ উপস্থাপনের পরেও সরকার তার অবস্থান পরিবর্তনে শুধু অস্বীকৃতি জানাচ্ছে না- বরং আরো দ্রæত এই গণবিরোধী দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগী হয়েছে। বুধবার এ বিষয়ে রাজধানীর গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসব কথা বলেন খালেদা।

খালেদা জিয়া বলেন, “দেশের উন্নয়ন ও জনজীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যদি দেশ এবং দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জনজীবন বিপর্যস্থ হয়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়- তাহলে সেই সিদ্ধান্ত হয় দেশবিরোধী-গণবিরোধী। বাগেরহাট জেলার রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ঠিক তেমনি একটি দেশবিরোধী-গণবিরোধী সিদ্ধান্ত।”

বিষয়টির ব্যাখ্যা করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “বিশ্বের বৃহত্তম ম্যাগগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট এবং মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে ৫৬৫ মেগাওয়াট ওরিয়ন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলেছে। দেশ-বিদেশের পরিবেশবিদ, সামাজিক সংগঠন এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিবাদ এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের প্রকল্পের মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার দৃষ্টান্ত উপেক্ষা করে গণবিরোধী অনির্বাচিত সরকার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের আরো একটি কয়লা-বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে জমি ভরাটের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে।”

তিনি অভিযোগ করে বলেন, “জনমত উপেক্ষা করে দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত জনগণের উপর জবরস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দিচ্ছে এই স্বৈরাচারী সরকার।

সুন্দরবনের এত কাছে স্থাপিত কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনিবার্য অশুভ ও মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়ার সব প্রমাণ উপস্থাপনের পরেও সরকার তার অবস্থান পরিবর্তনে শুধু অস্বীকৃতি জানাচ্ছে না, বরং আরও দ্রæত এই গণবিরোধী-দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগী হয়েছে।”

“এর দ্বারা আবারো প্রমাণিত হলো যে, এই সরকার স্বৈরাচারী বলেই জনমত কিংবা দেশের স্বার্থের পরোয়া করে না। যে প্রকল্প দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক বেষ্টনী ধ্বংস করবে, জীব-বৈচিত্র্যের বিলোপ ঘটাবে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংসের কারণ হবে, পরিবেশ ও পানি দূষিত করবে, আশে পাশের কৃষি জমির উর্বরা শক্তি এবং মৎস্য সম্পদ ধ্বংস করবে এবং সর্বোপরি যে প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক- তা বাস্তবায়নে সরকারের যুক্তিহীন জেদ ও দ্রæততা শুধু সন্দেহজনক নয়, দেশবাসীর জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।”

সুন্দরবনের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, “যে সুন্দরবন লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করছে, যে সুন্দরবন প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এই দেশকে আইলা, সিডর, ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচার জন্য প্রাকৃতিক সুরক্ষা দিচ্ছে- ইউনেসকো কর্তৃক ঘোষিত সেই আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য সুন্দরবনকে নিশ্চিত ধ্বংসের শিকার করার চক্রান্ত সফল হতে দেয়া যায় নাÑ দেয়া উচিত নয়। দেশের অস্তিত্ব ও স্বার্থের বিনিময়ে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর মুনাফা এবং অনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টা রোধ করা তাই সময়ের দাবি।” বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সুন্দরবনের এত কাছে পশুর নদীর তীরে রামপাল কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে এবং তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে সুদূর প্রসারী। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য বলে ঘোষিত সুন্দরবন, এই বনের বিরল প্রজাতির পশু-পাখি, বনের ভিতর ও পাশ দিয়ে বলে চলা নদী ও খালের মৎস্যসম্পদ এবং বিপুল বনজ সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার যে আশঙ্কা বিজ্ঞানীরা করছেন- তার প্রমাণ অসংখ্য।”

তিনি বলেন, “আমেরিকার টেক্সাসে ফায়েত্তি কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে ৩০ হাজার টন সালফারডাই অক্সাইড নির্গত হতো। এর ফলে টেক্সসের হাইওয়ে ২১’এর ৪৮ কিলোমিটার জুড়ে গাছপালা ধ্বংস হয়েছে। ফলে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পানি নির্গমন হলে তাতে বিভিন্ন মাত্রার দূষণকারী উপাদান থাকে। সে কারণে পৃথিবীর সব দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে ‘শূন্য নির্গমন’ নীতি অবলম্বন করা হয়।”

“কিন্তু ভারতীয় কোম্পানি ‘এনটিপিসি’ রামপালে এই নীতি অনুসরণ না করেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। অথচ এই কোম্পানিই যখন ভারতে ছত্তিশগড়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করতে চেয়েছিল তখন ‘শূন্য নির্গমন’ নীতি মানার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। ‘শূন্য নির্গমন’ নীতি অনুসরণ না করার ফলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ঘন্টায় নির্গত ৫১৫০ ঘনমিটার পানি পশুর নদীর পনিজ পরিবেশের তাপমাত্রা, পানি নির্গমনের গতি, পানিতে দ্রবীভূত নানান উপাদান বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তন করবে, যা পুরো সুন্দরবন এলাকার পরিবেশের উপর ধ্বংসকারী প্রভাব সৃষ্টি করবে।”

বিএনপি প্রধান বলেন, “গোটা বিশ্ব যখন আবহাওয়া পরিবর্তনের অনিবার্য্য বিপদ নিয়ে গভীর উদ্বিঘ্ন, তখন জেনে শুনে এই দেশ এবং তার কোটি কোটি অধিবাসীকে নিশ্চিত বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার যেকোনো অপচেষ্টার প্রতিবাদ করার দায়িত্ব আমাদের সবার।”

তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্থানেরও অনেক বিকল্প আছে- কিন্তু সুন্দরবনের কোন বিকল্প নেই। কাজেই সুন্দরবনকে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার হঠকারী, অযৌক্তিক ও অলাভজনক রামপালের সকল কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার জন্য আমরা সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।” এই দাবির পক্ষে সোচ্চার হওয়ার জন্য ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান খালেদা জিয়া।