গ্রাহকের ৬৫০০ কোটি টাকা দিচ্ছে না ৮১ বিমা কোম্পানি

নিউজ ডেস্ক: আস্থা সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিমা খাতের অবদান ১ শতাংশের নিচে। অর্থনীতিতে বিমার অবদান বাড়ানো এবং বিমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রতি বছরের মতো এ বছরও জাতীয় বিমা দিবস পালন করছে সরকার।

আজ বুধবার (১ মার্চ) জাতীয় বিমা দিবস। এ উপলক্ষ্যে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ ও বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) দেশব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। ‘আমার জীবন আমার সম্পদ, বিমা থাকলে নিরাপদ’ এ প্রতিপাদ্যে পালিত হচ্ছে এবারের বিমা দিবস।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দিবসটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সকাল ১০টায় শুরু হবে। ১১টার দিকে ভাষণ শেষে বিমা দিবসের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহম্মদ সলীম উল্লাহ। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন ও আইডিআরএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী।

উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার সময়ে সর্বস্তরের জনগণকে সংগঠিত করার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৬০ সালের ১ মার্চ তৎকালীন আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে এ অঞ্চলের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। আর এ তারিখটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি আইডিআরএ আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার ১ মার্চ কে ‘জাতীয় বীমা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে প্রতি বছরের এদিনে বিমা দিবস উত্থাপন করা হয়।

আইডিআরএ তথ্য মতে, দেশের বিমা খাতে জীবন ও সাধারণ বিমা কোম্পানির সংখ্যা ৮১টি। এ কোম্পানিগুলোতে গ্রাহকদের বিমার সংখ্যা রয়েছে ৮৮ লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৬টি। অথচ ২০২১ সালেও বিমা সংখ্যা ছিল ৯৪ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৫টিতে। অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ৬ লাখ বিমা কমেছে। সাড়ে ১৭ কোটি মানুষ ও দেশের সম্পদের মাত্র ৮৮ লাখ বিমা রয়েছে। যা সম্পদ ও জনসংখ্যার দিক থেকে অতি সামান্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিআরএর সাবেক সদস্য গকুল চাঁদ বলেন, দেশের বিমা কোম্পানির খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। কারণ কোম্পানিগুলো বিমা দাবি নিয়ে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করেন। বিমা করানোর সময় কোম্পানির এজেন্টরা অনেক প্রলোভন দেখায়। আবার মেয়াদ পূর্তি হওয়া বিমার টাকা কিংবা বিমা দাবি টাকা দিতে চায় না। ১০ হাজার টাকার বিমা দাবির জন্য আরও ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। এ কারণে বিমা করতে আসেন না সাধারণ মানুষ।

আইডিআরএর তথ্য মতে, ২০২২ সালে বিমার সংখ্যা ছিল ৮৮ লাখ ৮৬ হাজার ৪৩৬টি। সে বছরে মোট ৩০ লাখ ৬২ হাজার ৪৬৮টি বিমা দাবি ছিল গ্রাহকদের। এ গ্রাহকদের বিমার টাকার পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৯ লাখ ১২ হাজার ৮৬৯টি বিমার মোট ১০ হাজার ২৬০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বিমা দাবি পরিশোধ হয়েছে। অর্থাৎ ২০২২ সালে গ্রাহকদের ১১ লাখ ৪৯ হাজার ৫৯৯টি বিমা দাবির ৬ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা দিচ্ছে না ৮১টি বিমা কোম্পানিগুলো।

বিমা দাবি পরিশোধ না করায় প্রতিনিয়তই নতুন বিমার সংখ্যা কমছে। করোনার সময় অর্থাৎ ২০২০ সালে বিমা সংখ্যা ছিল ৯৬ লাখ ৫৪ হাজার। যা গত দুই বছরে সেখান থেকে ৮ লাখ কমে ৮৮ লাখে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০২১ সালে বিমা দাবির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৪৭৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৮ হাজার ৬৫৬ কোটি ২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে কোম্পানিগুলো। গ্রাহকদের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করেনি।

একইভাবে ২০২০ সালে ছিল বিমা দাবির পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৭১৭ কোটি ২৩ লাখ টাকার। সে বছর ৬ হাজার ৬৩১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার দাবি পরিশোধ করেছে। অর্থাৎ ৩ হাজার কোটি টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করেনি।

প্রাণঘাতী করোনার আগের বছর ২০১৯ সালে বিমা দাবির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৮২৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। দাবি পরিশোধ করেছে ৭ হাজার ৮৪০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। তার আগের বছর ২০১৮ সালে ১০ হাজার ৪৬৫ কোটি ৯১ লাখ টাকার বিমা দাবি ছিল। তার মধ্যে ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি ৬ লাখ টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করেছে।

বিমা দাবি পরিশোধ না করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিমা কোম্পানির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ করিব হোসেন। তিনি বলেন, বেশ কিছু কোম্পানি বিমা দাবি পরিশোধে গড়িমসি করছে। আমারা এসব কোম্পানির পর্ষদকে অবহিত করব। তারা যেন দ্রুত বিমা দাবিগুলো পরিশোধ করে।

তিনি বলেন,অধিকাংশ বিমা কোম্পানি গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ করছে। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির কারণে আমাদের বিমা ব্যবসার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এটা হতে দেওয়া যাবে না।

বিমা নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরামের প্রেসিডেন্ট বিএম ইউসুফ আলী বলেন, ৩৫টি জীবন বিমা কোম্পানির মধ্যে ২০-২৫টি কোম্পানি গ্রাহকদের বিমা দাবিগুলো যথা সময়ে পরিশোধ করছে। কিন্তু ১০ থেকে ১৫টি কোম্পানি গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধ করছে না। এ কারণে বিমা কোম্পানির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নেতিবাচক। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাশাপাশি সবারই উচিৎ তাদের চিহিৃত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আইডিআরএর তথ্য মতে, যেসব কোম্পানি গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধে গাফিলতি করছে সেগুলো হচ্ছে- বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্স, সানলাইফ ইনস্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার ইনস্যুরেন্স, হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী লাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ এবং ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি। সম্প্রতি এসব কোম্পানির এমডি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা মামলাও করেছে। বেশি কিছু কোম্পানির এমডি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে আইডিআরএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, ৮ থেকে ১০টি কোম্পানির বিরুদ্ধে বিমা দাবি পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে। আমরা এ কোম্পানি এমডি-চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদকে ডেকে এক মাসের মধ্যে বিমা দাবিগুলো পরিশোধ করতে নির্দেশনা দিয়েছি। তারা যেন কোনোভাবে ফাঁকি দিতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনে সম্পদ বিক্রি করে বিমা দাবি পরিশোধের কথা বলেছি।

গ্রাহকরা যাতে বিমা দাবি নিয়ে ভোগান্তিতে না পড়ে তার সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে ৮১টি বিমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে জীবন (লাইফ) বিমা কোম্পানি রয়েছে ৩৫টি। আর সাধারণ (নন-লাইফ) বিমা কোম্পানি রয়েছে ৪৬টি। গত বছরে নানামুখী সঙ্কটের মাঝেও জীবন বিমার তহবিল ও সাধারণ বিমার সম্পদ দুটোই বেড়েছে। এমনকি ২০২১ সালে করোনা মহামারির সঙ্কটের মাঝে বিশ্বব্যাপী মোট বিমা প্রিমিয়ামের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি যেখানে ৩ দশমিক ৪ ভাগে নেমে এসেছিল, সেখানে বাংলাদেশে বিমা প্রিমিয়ামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩ ভাগ, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ০৪ ভাগ।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষে গ্রস প্রিমিয়ামের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে জীবন বীমার গ্রস প্রিমিয়াম ১১ হাজার ৩৯৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর সাধারণ বিমা (নন লাইফ) ৫ হাজার ৪১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা।

যা সংকটের এ সময়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় তারল্যের যোগান দিচ্ছে। লাইফ ও নন-লাইফ বিমা কোম্পানির অর্জিত প্রিমিয়ামের থেকে কর বাবদ ২০২২ সালে ১৩০৫ কোটি ৭৩ লাখ সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে এ সময়ে দেশের অর্থনীতিতেও এ খাতের অবদান বেড়েছে। দেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ বিমা সাথে সম্পৃক্ত এবং কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। আর এ সাফল্যে বড় অবদান রেখেছে, এ খাতের নতুন নতুন সব জনবান্ধব ও কল্যাণমুখী বিমা।

এ বিষয়ে আইডিআরএ পরিচালক (উপসচিব) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিমা খাতে বিরাজমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনের উদ্দেশে সরকারের সাথে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে আইডিআরএ। বিমা শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে ২০৪১ সালের উন্নত, সমৃদ্ধ, স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে আইডিআরএ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, বিমা খাতের উন্নয়নের জন্য ১১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার সরকারি অর্থায়ন এবং বিশ্বব্যাংকের সাড়ে ৫১৩ কোটি টাকাসহ মোট ৬৩২ কোটি টাকার অর্থায়নে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। এছাড়াও বিমার গুরুত্ব অনুধাবন করে পুরানো বিমা আইনকে ঢেলে সাজিয়ে নতুন বিমা আইন, ২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।