দ্রুত মজুদ কমছে খাদ্যশস্যের

ডেস্ক: আসন্ন শীতে করোনার আরেক দফা ঢেউ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিজ্ঞানীরা। এরই মধ্যে ইউরোপের ওপর দিয়ে দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ ঢেউ বয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশকেও আসন্ন শীতে আরেকটি বড় সংক্রমণ ঢেউ মোকাবেলা করতে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ আশঙ্কায় রয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশও। মহামারীসৃষ্ট অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে এসব দেশের অধিকাংশই এখন খাদ্যের মজুদ বাড়িয়ে তুলছে। যদিও বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে খাদ্যের সরকারি মজুদ এখন কমতির দিকে। বর্তমানে এ মজুদের পরিমাণ নেমে এসেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায়ও নিচে।

খাদ্য অধিদপ্তর
খাদ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত সরকারি গুদামের মজুদ পরিস্থিতি।

চলতি বছর মহামারীর কারণে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন অনেকে। ফলে সরকারি ত্রাণ সহযোগিতার ওপর মানুষের নির্ভরতাও অনেক বেড়েছে। সামনের দিনগুলোয় দ্বিতীয় সংক্রমণের ঢেউ বয়ে গেলে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে, তা মোকাবেলার জন্য সরকারি খাদ্যগুদামগুলোয় এখনই মজুদ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বুধবার পর্যন্ত হালনাগাদকৃত দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ওই দিন পর্যন্ত (১৪ অক্টোবর) দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুদের পরিমাণ ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৮০০ টন। এর মধ্যে চাল রয়েছে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬০ টন ও গম ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৪০ টন। প্রতিবেদনে এ মজুদ পরিস্থিতিকে সন্তোষজনক বলে দাবি করা হলেও পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের একই সময়ে দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুদ ছিল ১৭ লাখ ২০ হাজার ৩২০ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খাদ্যশস্যের মজুদ হ্রাস পেয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি।

অন্যদিকে এক মাস আগের মজুদ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েও বলা যায়, দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ হ্রাস পাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সরকারি গুদামগুলোয় মোট খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ১৯ হাজার টন। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ হ্রাস পেয়েছে ১৬ শতাংশের কাছাকাছি।

অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় পরিচালিত স্থানীয়ভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানের ফলাফলও খুব একটা সন্তোষজনক নয়। আমন মৌসুমে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে সংগ্রহের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি থাকলেও বিপরীত ঘটনা ঘটেছে বোরো মৌসুমের ক্ষেত্রে। পরিসংখ্যান বলছে, সরকারি মজুদ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা থেকে চলতি বছর বোরো মৌসুমে মোট আট লাখ টন ধান সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ টন। এছাড়া চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ১১ লাখ টন। এর বিপরীতে সিদ্ধ ও আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে যথাক্রমে ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮৯০ ও ৯৯ হাজার ১২৩ টন।

মহামারীসৃষ্ট অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় বিশ্বের অনেক দেশেই এখন খাদ্যের উৎপাদন ও মজুদ বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে গমের শীর্ষ আমদানিকারক মিসর এপ্রিলের পর থেকে পণ্যটির আমদানি বাড়িয়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি হারে। খাদ্যশস্যের মজুদ রেকর্ড সর্বোচ্চ পরিমাণে নিয়ে এসেছে জর্ডান। এছাড়া খাদ্যশস্যের অন্যতম শীর্ষ ভোক্তাদেশ চীনও এখন আমদানি বাড়িয়ে চলেছে। আমদানি বাড়াচ্ছে পাকিস্তান, মরক্কোসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশ খাদ্যশস্যের মজুদ বাড়াতে এরই মধ্যে আগামী কয়েক মাসের জন্য আমদানি শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে।

এর কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, মহামারীর শুরুতেই দেশে দেশে বন্দরগুলোর পণ্য খালাস ও বোঝাই কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটার পাশাপাশি বিশ্ববাণিজ্যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দেয়। একই সঙ্গে স্থানীয় সরবরাহ কার্যক্রমকেও স্থবির করে দেয় মহামারীর প্রাদুর্ভাব। এছাড়া শুরুতেই কয়েকটি দেশে ভোক্তাদের অতিরিক্ত মজুদপ্রবণতা বাজারে খাদ্যপণ্যের মারাত্মক সরবরাহ ঘাটতি তৈরি করে। দেশে দেশে মহামারীর মতো এ অতিরিক্ত প্রবণতাও ভোক্তাদের মধ্যে সংক্রমিত হতে থাকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। ফলে দেশগুলোও আমদানি বাড়ানোর তাগিদে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ক্রয়ের জন্য একের পর এক টেন্ডার ছাড়তে থাকে।

অন্যদিকে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্য আমদানি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে মহামারীসৃষ্ট অনিশ্চয়তাকে। এফএওর জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আবদোলরেজা আব্বাসিয়ানের বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গ জানাচ্ছে, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ভবিষ্যতে আবারো সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটানোর আশঙ্কা থেকে অনেকগুলো দেশ এখন খাদ্য আমদানি বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। এর মধ্যে প্রকৃতপক্ষেই খাদ্যের কৌশলগত মজুদ বাড়ানোর উদ্দেশ্য রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি দেশের। বাকি দেশগুলোর আমদানি বাড়ানোর পেছনে যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, স্থানীয় সরবরাহ পরিস্থিতি ও স্থানীয় বাজারে মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোও রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণেও কোনো কোনো দেশ আমদানি বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।

বাংলাদেশেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের অতিসত্বর ১০-১৫ লাখ টন চাল আমদানি করে রাখা উচিত বলে মনে করছেন সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল।  গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আগামী বিপদের কথা ভেবে বিভিন্ন দেশ খাদ্য আমদানি করা শুরু করে দিয়েছে। গমের ক্ষেত্রে যেহেতু এমনিতেই আমরা অনেকটা আমদানিনির্ভর, এ কারণে গমের ক্ষেত্রে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে চালটা এখন আমাদের আমদানি করা উচিত। এজন্য সরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে শুল্ক সুবিধা দিয়ে আমদানি বাড়ানো প্রয়োজন, যেটা বিশ্বের অন্য অনেক দেশ করছে।

বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা থেকে মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রীও। তবে এ বছর খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রয়োজনমাফিক না হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সাম্প্রতিক এক প্রাক্কলনে বলা হয়, সদ্যসমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ৩ কোটি ৬০ লাখ টনে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) দাবি, চলতি বছর চালের উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ সম্ভাবনা নিয়েও বড় ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত খাদ্য আমদানি বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামানও।  সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে শস্য উৎপাদন সম্পর্কে যেসব তথ্য দেয়া হচ্ছে, সেগুলো নিয়েও সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। তবে খাদ্যশস্যের মজুদ কোনোভাবেই দুর্বল করা যাবে না। প্রয়োজনে এখনই আমদানির উদ্যোগ নিয়ে মজুদ বাড়াতে হবে।

এর ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমদানি চাহিদা বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের মূল্যসূচকও এখন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বরেও টানা চতুর্থ মাসের মতো ঊর্ধ্বমুখিতায় ছিল বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য সূচক। ওই সময় বৈশ্বিক গড় খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ২ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে গত সপ্তাহেই মহামারীর কারণে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সংকট আরো প্রকট হয়ে ওঠার হুঁশিয়ারি দিয়েছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে খাদ্যনিরাপত্তা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি জনসাধারণের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়তে পারে। কারণ বিশ্বের দেশে দেশে অর্থনীতিতে ধস নামানোর পাশাপাশি কর্মহীনতাও বাড়িয়েছে মহামারীর প্রাদুর্ভাব।

একই পরিস্থিতি বাংলাদেশেও। মহামারী দেখা দেয়ার পর থেকেই অর্থনীতির স্থবিরতায় প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষের আয়ও হ্রাস পেয়েছে। বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, করোনার প্রথম পাঁচ মাসে দেশে পরিবারপিছু মাসিক আয় হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৪ হাজার টাকা করে। দেশে এমনিতেই এখন আলুসহ কয়েকটি শস্যের মূল্যে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় খাদ্যশস্যের সামান্যতম ঘাটতি দেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সংকটকে আরো প্রকট করে তোলার আশঙ্কা রয়েছে।

সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, গত বছর এ সময়ে খাদ্যশস্যের মজুদ এখনকার চেয়ে পাঁচ লাখ টন বেশি ছিল। খাদ্যশস্যের মজুদ বেশি হলে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এখন মজুদ যে পর্যায়ে আছে, সেটিকে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। যদি এর চেয়ে কম হতো, তাহলে সেটি দুশ্চিন্তার ছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে আমন ধান চলে আসবে। ডিসেম্বর থেকে আমরা জোরেশোরে ধান কেনা শুরু করব। এছাড়া দুই লাখ টন আমদানির গম আসবে। সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির জন্যও পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। ফলে আমাদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। যদি হঠাৎ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলে না আসে, তাহলে আমাদের খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি স্বাভাবিকই রয়েছে। এছাড়া খাদ্যশস্য আমদানির ক্ষেত্রে অনুমতি নেয়া আছে। যদি কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি শুরু হয়ে যায়, তাহলে আমাদের সে প্রস্তুতিও রয়েছে। – বণিক বার্তা