ইউপি নির্বাচন: ভোট কারচুপি ও ছিনতাই করা হয়েছে -বিএনপি

নিউজ নাইন২৪ডটকম, ঢাকা: ইউপি নির্বাচনে কারচুপি ও ভোট ছিনতাইয়ের মাধ্যমে সরকারের দানবীয় চরিত্র ফের উন্মোচিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি। মঙ্গলবার বিকেলে দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।

তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার ব্রিফিংয়ে আজকের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপারে সিল মারা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিষয়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করেছিলাম। এর পরও অনেক সহিংস ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, পিরোজপুর জেলাধীন নেছারাবাদ উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সবক’টি ভোটকেন্দ্র দখল করে নিয়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ভোটকেন্দ্রগুলো থেকে বিএনপি’র এজেন্টদের বের করে দিয়ে তারা নিজেদের প্রার্থীর ব্যালটে সিল মারার তা-ব চালিয়েছে। জেলার ভান্ডরিয়া থানার ইকরি ইউনিয়ন যুবদল সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছে আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তিনি এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। আমি দলের পক্ষ থেকে তার আশু সুস্থতা কামনা করছি এবং অবিলম্বে তার ওপর হামলাকারী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানাচ্ছি।

মুন্সীগঞ্জ: জেলাধীন সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর, রাজনগর, কালিনগর, রসুনিয়া ও মধ্যপাড়া ইউনিয়নের সকল ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।

পটুয়াখালী: জেলাধীন গলাচিপা উপজেলার ৯ নং কলাগাছিয়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী দুলাল চৌধুরী তার ভাই-ভাতিজা ও দলের অন্যান্য সন্ত্রাসীদের নিয়ে ১, ২, ৩, ৬ নং ভোটকেন্দ্র থেকে বিএনপি’র এজেন্টদের মারধর করে বের করে দিয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি’র সহায়তায় সন্তাসীরা এলাকায় ব্যাপক তান্ডব শুরু করেছে। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেনের বাড়ির কাছের কেন্দ্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দখলে নিতে না পারার কারণে সেই কেন্দ্রটির ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। বাউফল উপজেলা ১নং কাছিপাড়া ইউনিয়নে বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর এজেন্টদেরকে অস্ত্রের মুখে সবগুলো কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।

বরিশাল: জেলাধীন উজিরপুর উপজেলার অটরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পশ্চিম অটরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র এবং হাবিবপুর হাইস্কুল কেন্দ্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দখলে নিয়ে দেদারসে সিল মেরেছে। বড়াকোঠা ইউনিয়নের সকল ভোটকেন্দ্র স্থানীয় সংসদ সদস্য ইউনুস তালুকদার নিজেই তার লোকদের নিয়ে সকাল ৯টার পরপরই দখলে নিয়েছে।

ঢাকা: জেলাধীন দোহার উপজেলার কুসুমহাটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বাস্তা মাদরাসা কেন্দ্র, কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র, বাবুডাঙ্গি মক্তব কেন্দ্রসহ অন্যান্য কেন্দ্রের চতুর্দিকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র অবস্থায় অবস্থান নিয়েছে, যাতে বিএনপি’র ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না পারে।

কিশোরগঞ্জ: জেলার সদর উপজেলার রশিদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৫ নং ভোট কেন্দ্র্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দখল করতে গেলে ভোটারদের সাথে সংঘর্ষ বেধে যায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেখানে সংঘর্ষ চলছে।

লক্ষীপুর: জেলাধীন কমলনগর উপজেলার ৪টা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সকল ভোটকেন্দ্রে সিল মেরেছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা। বাধা দিতে গেলে সন্ত্রাসীরা বিএনপি’র ৮/১০ জন নেতাকর্মী ও সমর্থককে প্রহার করে গুরুতর আহত করেছে।

ভোলা: ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোলা জেলাধীন চরফ্যাশন উপজেলার এওয়াজপুর ইউনিয়ন যুবদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমানকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হামলায় যুবদল নেতা শাহজাহান ও মমিনুল ইসলাম মিঠু এবং ছাত্রদল নেতা বিশু আহত হয়েছেন। সকল ভোটকেন্দ্রে প্রশাসনের সহায়তায় বিএনপি এজেন্টদের বের করে দিয়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। মাদ্রাজ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও শ্রমিক দল নেতা মিজান, হাবিব, শাহাবুদ্দিন, রাসেল ও হাসানকে দেশীয় অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে গুরুতর আহত করে। তারা বর্তমানে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কলমী ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বেপারীকে লাঞ্ছিত করে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ৩ নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা বদু গাজী ও ফিরোজ মালকে বেধড়ক লাঠিপেটা করে আহত করা হয়েছে। সকাল থেকেই ৭টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সকল ভোটকেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে আওয়ামী লোকেরা।

কিশোরগঞ্জ: জেলাধীন সদর উপজেলার মাইরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে সরকার দলীয় সন্ত্রাসীরা হামলা করে কেন্দ্র দখলে নিয়েছে। মহিনন্দ ইউনিয়নের শুকুর মাহমুদ বিদ্যালয় কেন্দ্রটিও দখলে নিয়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।

সাতক্ষীরা: জেলাধীন কলারোয়া উপজেলার যুগীখালী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সকল ভোটকেন্দ্র দখল করে আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা নৌকা প্রতীকে সিল মেরেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কখনোই এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হতে পারেনি। কুশোডাঙ্গা ইউনিয়নে শাকদা প্রাইমারী স্কুল ভোটকেন্দ্র, পানি কাউড়িয়া হাইস্কুল কেন্দ্র, বায়টা প্রাইমারী স্কুল কেন্দ্র, কলাটুপি প্রাইমারী স্কুল কেন্দ্র সহ প্রায় সব কেন্দ্রই দখল করে নৌকা প্রতীকে সিল মেরেছে আওয়ামী লীগের লোকেরা। দেয়াড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে খোদ্দ হাইস্কুল কেন্দ্র, পাকুড়িয়া প্রাইমারী স্কুল কেন্দ্র, খলিলপুর প্রাইমারী স্কুল কেন্দ্র দখলে নিয়ে নৌকা প্রতীকে ইচ্ছেমতো সিল মেরেছে আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী। হেলাতলা ইউনিয়ন এবং ক্যারেলকাটা ইউনিয়নেও একই অবস্থা এবং সেখানে আজ থেকে ব্যাপক গোলাগুলি এবং নারকীয় তা-ব চালিয়েছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি’র মেম্বার প্রার্থী ও ইউনিয়ন যুবদল সভাপতি রোকনউদ্দিনকে ধরে নিয়ে গেছে র‌্যাব। রোকনউদ্দিনের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি জানান রিজভী।

অন্তত ৫০ ইউপির নির্বাচন বাতিল করে উদাহরণ সৃষ্টি করুন -সিইসিকে বিএনপি:

এদিকে, ভাঙচুর, হামলা, সহিংসতা, গোলাগুলি, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাইসহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে এর অন্তত ৫০টির নির্বাচন বাতিলের অনুরোধ করেছে বিএনপি। আজ বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে এই অনুরোধ জানায়। বৈঠক শেষে বের হয়ে বিএনপি ওই ভাইস চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচনের দিন সব কর্তৃত্ব থাকে নির্বাচন কমিশনের। পুলিশ বা অন্যান্য অথরিটি তাদের অধীনেই থাকে। এবারই আমরা এটার ব্যতিক্রম দেখলাম। বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় সরকারি বাহিনী, সরকারি দল পুলিশ তাদের সহযোগিতা করেছে এবং সেই সহযোগিতার মধ্য দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেখানে যা শক্তি সেই শক্তি নিয়ে নির্বাচন করে তারা ফলাফলের জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে।’

বিএনপি নেতা বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে একটা অনুরোধ করেছি, সেটা হচ্ছে ৭১৩টি ইউনিয়নের অধিকাংশেই কারচুপি হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো ইউনিয়ন আছে যার সব কেন্দ্রেই এককভাবে শক্তিধর ও সরকারি দলের আনুকুল্যে তারা হয়তো চেয়ারম্যান ডিক্লেয়ারেশন পেতে পারে। আমাদের অনুরোধ ছিল, অন্তত নির্বাচন কমিশন একটা উদাহরণ সৃষ্টি করুক। সেটা হলো, ৫০টি হলেও ইউনিয়নের নির্বাচন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন প্রমাণ করুক যে আমরা আসলেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছি। নির্বাচনগুলো বাতিল করে দিতে পারলে কমিশনের ওপরে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরে আসবে।’ এসব কথাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে আলোচনা করেছেন বলে জানান বিএনপির এই নেতা।

আজকের নির্বাচনকে তামাশার নির্বাচন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে যেসব কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কাজ করেছেন তারা যথাযথ ভূমিকা পালন করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হতো। আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে প্রতিনিধি দলে ছিলেন- বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ক্যাপ্টেন সুজা উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক চৌধুরী, যুগ্মসম্পাদক শাজাহান মিয়া এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন।

আজ সকাল ৮টায় ৩৪ জেলায় একযোগে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে বিকাল ৪টায় শেষ হয়। এবারই সারা দেশে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা সহিংসতা, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, গুলি বর্ষণ, মারপিট, হামলা ও কেন্দ্র দখলের খবর পাওয়া গেছে।

নির্বাচনের আগের দিনই এসব সহিংসতার আশঙ্কা করেছিল নির্বাচন কমিশন। গতকাল সোমবার ভোটপূর্ব সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনী সহিংতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন সিইসি কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ। তিনি খোলাখুলিই বলেন, ‘নির্বাচনী সহিংসতা আমরা কমিয়ে আনতে পারছি না। কারণ অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে কাঙ্খিত সহযোগিতা পাচ্ছি না।’ সিইসি আরো বলেন, ‘কোনো কেন্দ্রে ভোট কারচুপি ও সহিংসতা হলে ওই কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়ী হবেন।’