ইউনেসকোর প্রতিবেদন: সুন্দরবনের ক্ষতির কারণ ফারাক্কা

Image result for সুন্দরবন ফারাক্কাডেস্ক: ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করলেই সুন্দরবন রক্ষা পাবে’- জাতিসংঘের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো কিন্তু তেমনটা বলছে না। সংস্থাটি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির এক নম্বর কারণ হিসেবে গঙ্গা নদীর উজানে ভারতের নির্মাণ করা ফারাক্কা ব্যারাজকে চিহ্নিত করেছে। ইউনেসকোর রিয়েকটিভ মনিটরিং মিশন সম্প্রতি সরকারের কাছে যে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে, তাতে এসব কথা বলা হয়েছে। ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের পর থেকে সুন্দরবনের নদীতে মিষ্টি পানির প্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে আসে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে গঙ্গা নদী দিয়ে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। এজন্য বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পানির প্রবাহ বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘ফারাক্কার কারণে সুন্দরবন শুধু নয়, পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। গঙ্গায় পানির প্রবাহ বাড়ানোর মাধ্যমে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়ানোর জন্য আমরা আরো চেষ্টা চালিয়ে যাবো।’

ইউনেসকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সত্তরের দশকে নির্মিত ওই ব্যারাজের কারণে উজানে বিপুল পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বনের নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নদীর বুকে পলি জমার হারও বেড়ে গেছে, যা সামগ্রিকভাবে সুন্দরবনের প্রতিবেশব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে। এর ফলে সুন্দরবনে নতুন করে বৃক্ষরাজি জন্মানোর পরিমাণ কমে গেছে।

এ ব্যাপারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘ফারাক্কা যে সুন্দরবনের জন্য এক নম্বর হুমকি, তা আমি গত ২০ বছর ধরে বলে আসছি।’ তবে গঙ্গা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ যে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পায়, তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব ছিল- এই মন্তব্য করে এই পানি বিশেষজ্ঞ বলেন, গঙ্গা ব্যারাজ করলে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় গড়াই নদ দিয়ে ১৪ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ করিয়ে তা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে নেয়া সম্ভব।

ইউনেসকোর প্রতিবেদন বলছে, লবণাক্ততা বাড়ায় সুন্দরবনে লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এমন প্রজাতির বৃক্ষের পরিমাণ বাড়ছে। মিষ্টি পানির শ্বাসমূলীয় বৃক্ষরাজির পরিমাণ কমে আসছে। নতুন বৃক্ষ জন্মানো কমে আসায় বাড়ছে বৃক্ষহীন ফাঁকা স্থানের পরিমাণ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের পানির প্রবাহ মূলত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার উপর নির্ভরশীল। ১৯ শতক থেকে এই তিন নদ-নদীর মধ্যে গঙ্গা থেকে কৃষিতে সেচ ও শিল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ পানি উত্তোলন শুরু হয়। ধারাবাহিকভাবে পানি উত্তোলন বাড়ার একপর্যায়ে বাংলাদেশ সীমানার ১৫ কিলোমিটার উজানে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কায় ভারত সরকার একটি ব্যারাজ নির্মাণ করে। ওই ব্যারাজের মাধ্যমে ভারত উজান থেকেই বিপুল পরিমাণ পানি সরিয়ে ফেলে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। এতে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি সুন্দরবনের ভূমি অংশে গিয়ে জমা হয়। বনের ভূমি উঁচু হতে থাকে। আর দীর্ঘ মেয়াদে জোয়ারের পানি বনের ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা পায়।

ইউনেসকোর ২০১১ সালে সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির পরিবর্তন নিয়ে করা একটি গবেষণা প্রতিবেদনের উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের বেশি লবণাক্ত এলাকা পশ্চিমাংশে জীববৈচিত্র্য কম এবং পূর্বাংশে কম লবণাক্ত এলাকায় জীববৈচিত্র্য বেশি। তাই সুন্দরবনে ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে লবণাক্ততার পরিমাণ যত বাড়ছে, জীববৈচিত্র্যের পরিমাণ ততই কমছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ১৯৮৫ সালে সুন্দরবনের মাঝারি লবণাক্ত এলাকাগুলো বেশি লবণাক্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে। আরেকটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরীর আগা মরা রোগের জন্য সুন্দরবনের পানিতে ভারী ধাতুর পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে।

লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে সুন্দরবনের অনেক বৃক্ষ ও প্রাণী আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়ানোর জন্য প্রতিবেদনে দেরি না করে দুটি জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়ানোর জন্য গঙ্গা চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বিত ও যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়ে।

দ্বিতীয়ত, সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ ধরে রাখতে একটি পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। নিয়মিতভাবে সুন্দরবনের পানির গুণগত মান ও লবণাক্ততার পরিমাণ মাপতে হবে। এমনকি সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থা নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে পুরো সুন্দরবনের পানির প্রবাহ ঠিক থাকে এবং কোনো সমস্যা হলে দ্রুত তা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া যায়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রী বলেন, ‘শুধু ফারাক্কার কারণে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বাড়ছে বলে আমি মনে করি না। শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ করার কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এতে সমুদ্রের লবণপানি সুন্দরবনে প্রবেশ করছে। কিন্তু ইউনেসকোর প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কিছু বলা নেই।’

বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান এ ব্যাপারে বলেন, ‘ফারাক্কা বাঁধের কারণে যে সুন্দরবনের ক্ষতি হচ্ছে, তা ৪০ বছর ধরে কয়েকশ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। আর আবহওয়া পরিবর্তনের বিষয়টি আমরা গত ১০-১২ বছর ধরে শুনছি। সাম্প্রতিক সময়ে যেকোনো প্রাকৃতিক পরিবর্তনকে আবহওয়া পরিবর্তনের উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। ফলে সুন্দরবন রক্ষার জন্য আমাদের প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এগোতে হবে।’