আস্থা নেই শেয়ারবাজারে

২০১০ সালে ধসের পাঁচ বছর পরও বিনিয়োগকারীর কাছে এখনো আস্থাহীন দেশের শেয়ারবাজার। এখনো এটি পুঁজি হারানোর বাজার। ভালো-মন্দ বেশির ভাগ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেও লাভের দেখা মিলছে না। তাই বাজারে আসতে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।

বেশ কিছুদিন ধরেই বাজারে ক্রেতার সংকট। শেয়ার বিক্রি করেও লাভ না পাওয়াই এ সংকটের প্রধান কারণ। ফলে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করছেন না কেউ, নতুন করে কিনছেনও না। এ কারণেই ক্রেতা-সংকট বাজারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মতে, কেলেঙ্কারির ঘটনার পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করা হলেও এ কমিশনের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর আস্থা ফেরাতে বিএসইসির শীর্ষ পদে পরিবর্তন দরকার।
শেয়ারবাজারের আস্থাহীনতা ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন বলেন, ‘কার হাতে এমন জাদু আছে, বাজারকে পরিপূর্ণ আস্থার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে পারে।’ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তনের বিষয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে খায়রুল হোসেন বলেন, ‘উনি মুরব্বি মানুষ। উনি বলতেই পারেন। কিন্তু কোন যুক্তিতে তিনি এ পরিবর্তনের কথা বলেছেন সেটি কেবল উনিই ভালো বলতে পারবেন।’
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে নতুন যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে, সেগুলোর মান নিয়েও রয়েছে বিনিয়োগকারীদের নানা প্রশ্ন। এ কারণে তালিকাভুক্তির কিছুদিন যেতে না যেতেই অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর দামের নিচে নেমে গেছে।
সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রিজেন্ট টেক্সটাইলের কথা। ১০ টাকা অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালুর সঙ্গে ১৫ টাকা অধিমূল্য বা প্রিমিয়ার যোগ করে আইপিওতে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করা হয়েছিল ২৫ টাকায়। কিন্তু লেনদেন শুরুর দ্বিতীয় দিনে এসেই এই শেয়ারের দাম আইপিও দামের নিচে নেমে যায়।

গত বছরের ডিসেম্বরে লেনদেন শুরু হয়েছিল বস্ত্র খাতের আরেক কোম্পানি হামিদ ফেব্রিকসের। অভিহিত ও অধিমূল্য মিলিয়ে আইপিওতে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৩৫ টাকা। এক বছর না যেতেই কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য নেমেছে ২১ টাকায়। তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিটি শেয়ারধারীদের জন্য ১৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আইপিওতে কোম্পানিটির প্রতিটি বাজারগুচ্ছে ছিল ২০০ শেয়ার। সেই হিসাবে একজন বিনিয়োগকারীকে আইপিওতে ২০০ শেয়ারের জন্য বিনিয়োগ করতে হয়েছে সাত হাজার টাকা।
মানহীন কোম্পানির আইপিও অনুমোদন প্রসঙ্গে এম খায়রুল হোসেন বলেন, ভালো কোনো কোম্পানি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে বাজারে আসবে না। তাই কিছু কোম্পানিকে অভিহিত মূল্যে বাজারে আসার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
যদি ওই বিনিয়োগকারী তালিকাভুক্তির পরপর আইপিও শেয়ার বিক্রি না করে দীর্ঘ মেয়াদে ধরে রাখেন, তাহলে লভ্যাংশ পাওয়ার পরও ২০০ শেয়ারে প্রায় তিন হাজার টাকার মতো লোকসান। সেকেন্ডারি বাজারে শেয়ারের ক্রমাগত দরপতনের কারণেই এমনটি ঘটছে।
বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আস্থাহীনতার কারণে বাজারে নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না কেউ। অথচ শেয়ারের দাম যে পর্যায়ে নেমে এসেছে, তা বিনিয়োগের জন্য খুবই আকর্ষণীয়। তারপরও ক্রেতা নেই বাজারে।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভীর মতে, বর্তমান বাজার ক্রেতার জন্য ভালো, বিক্রেতার জন্য নয়। ক্রেতার জন্য ভালো বাজারে পর্যাপ্ত ক্রেতা আসছে কি—পাল্টা প্রশ্নে শাকিল রিজভীর উত্তর, ‘না, ক্রেতাবান্ধব বাজারেও প্রত্যাশিত ক্রেতা নেই।’
বাজারে প্রত্যাশিত ক্রেতা না আসার প্রধান কারণ হিসেবে শাকিল রিজভী বললেন আস্থাহীনতার কথা। শাকিল রিজভী নিজে একটি ব্রোকারেজ হাউসের মালিক। ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে বাজারে শেয়ার কেনাবেচা করেন বিনিয়োগকারীরা।
লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর মধ্যে একজন চট্টগ্রামের টিকলু কান্তি দাস। তাঁর কাছে শেয়ারবাজার এখন চরম এক মানসিক যন্ত্রণার নাম। কারণ, এ বাজারে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব তিনি। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও ফিরে পাচ্ছেন না হারানো পুঁজি। তাই শেয়ারবাজার থেকে যতটা পারেন দূরে থাকার চেষ্টা করছেন বলেই  জানালেন তিনি।
স্বস্তি নেই শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিজীবীদেরও। শেয়ার কেনাবেচা কমে যাওয়ায় ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো না। খরচ কমাতে চাকরি ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। চাকরি হারানোর ভয়ে আছেন এসব প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা।
বিনিয়োগকারী থেকে ব্রোকারেজ হাউসের মালিক, শেয়ারবাজারে চাকরিজীবী থেকে চাকরিদাতা—আসলে স্বস্তিতে নেই কেউই। অথচ ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে আস্থা ফেরাতে দেওয়া হয়েছে অনেক প্রণোদনা। গত পাঁচ বছরের আইনকানুন, বিধিবিধান থেকে শুরু করে অনেক পরিবর্তনই হয়েছে। কারসাজি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারে গঠন করা হয়েছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। পুনর্গঠন করা হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এত সব পরিবর্তনের বাতাস মিলছে না বাজারের পালে।
সেই কারণে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রায় ৯ হাজারে উঠে যাওয়া দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচকটি ২০১৩ সালের এপ্রিলে নেমে এসেছিল সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৫০০ পয়েন্টের নিচে। আর এখন এসে সেই সূচক সাড়ে ৪ হাজার পয়েন্টকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ ২০১০ সালের পর গত পাঁচ বছরে ৭০টির বেশি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তাতেও সূচকের খুব বেশি উন্নতি হয়নি।
বাজারের দৈনন্দিন লেনদেনের অবস্থা আরও খারাপ। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইতে লেনদেন উঠেছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকায়। কমতে কমতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সেটি নেমে আসে সর্বনিম্ন ১০১ কোটি টাকায়। ২০১৪ সালে ডিএসইতে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। সদ্য বিদায়ী ২০১৫ সাল শেষে দৈনিক গড় লেনদেন আরও কমে নেমে এসেছে ৪২২ কোটিতে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী  বলেন, ‘আমাদের বাজারের যে শক্তি, তাতে এ বাজারে দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার লেনদেন প্রত্যাশিত। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। কারণ, বাজারে বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ নেই। একদিকে আস্থার সংকটের কারণে নতুন বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসছেন না। অন্যদিকে, পুরোনো বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব ঋণভারে জর্জরিত। ফলে এসব হিসাবে কোনো লেনদেন হচ্ছে না।
কেন আস্থার সংকট কাটছে না জানতে চাইলে ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ২০১০ সালের চেয়ে এখনকার বাজারে অস্থিরতা অনেকাংশে কমেছে। তবে এখনো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। কারসাজির ভয় যেমন আছে, তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা সমস্যাও পুরোপুরি দূর হয়নি। বিনিয়োগকারীদের ঋণ হিসাবগুলো সচল করার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এ ছাড়া শেয়ারবাজারের খারাপ অবস্থার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও অনেকাংশে দায়ী।
তবে গত পাঁচ বছরে শেয়ারবাজারে মৌলিক কিছু পরিবর্তনও হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা (ডিমিউচুয়ালাইজেশন) করা, পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ সিকিউরিটিজ আইন যুগোপযোগী করা অন্যতম। এসব কাঠামো ও আইনগত পরিবর্তনের পরও সুফল নেই।
মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ডিমিউচুয়ালাইজেশনসহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য আইনি পরিবর্তনের সুফল পেতে আরও সময় লাগবে।
বর্তমান বিএসইসির হাত ধরে শেয়ারবাজারে কিছু পরিবর্তন হলেও সংস্থাটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের পরিপূর্ণ আস্থা ফেরেনি। মানহীন কিছু কোম্পানির শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তি নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বিনিয়োগকারীদের কাছে। এ ছাড়া কারসাজি ও আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখিয়েছে সংস্থাটি, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা স্থাপনে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, ভালো কোম্পানি বাজারে আসছে না বলেই বাজার এখনো একটি দুষ্টচক্রের হাতে ঘুরপাক খাচ্ছে।